সালমান হাসান: বড় বড় হরফে লেখা নীতিবাক্য-‘আমি ও আমার অফিস দুর্নীতিমুক্ত’। আদতে অফিসটির আপদমস্তক অনিয়মে জর্জরিত। নীতিবাক্যের নিচে এও লেখা আছে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু বিনা বাধায় ঘুষের বান্ডিল ঢোকে অহরহ। জমি কেনাবেচা করতে এসে শ্রম, ঘাম-রক্ত নিঙড়ানো উপার্জিত অর্থ ‘রেজিস্ট্রি অফিস’ নামক হাঙরের মুখে ঢালতে হয়।
অফিসটিতে কর্মরতদের মত এখানকার টেবিল, চেয়ার, দেয়াল ও ফ্যানও নাকি টাকা খায়। হলার মেশিনের মত হা করে থাকে সবাই। এমন অভিযোগ করেছেন জমি কেনাবেচা করতে আসা মানুষজন।
যশোর শহরের শহীদ মশিয়ূর রহমান সড়কে রেজিস্ট্র্রি অফিসের অবস্থান। নিচতলায় সদর সাব-রেজিস্ট্রার ও ওপর তলায় জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয়। অফিসের ভেতরে ঢুকলে দেখা যায় সিটিজেন চার্টার। সেখানে দলিলের নিবন্ধ ফিস থেকে শুরু করে বিভিন্ন সেবার আর্থিক মূল্য লেখা আছে। কিন্তু সেটি একটি কাগুজে ব্যাপার। চার্টারে লেখা সরকারি রেটে কোন সেবা এখানে পাওয়া যায় না। এখানকার কর্মচারি-কর্মকর্তাদের ধার্য রেট ছাড়া কোন কাজ হয় না। ‘আমি ও আমার অফিস দুর্নীতিমুক্ত’- সততার এই বাণীর আড়ালে চলে ঘুষ বা উৎকোচ নামের ‘ফেল কড়ি মাখ তেল’র কারবার। টাকা না ঢাললে দিনের পর দিন চক্কর কাটতে হয় রেজিস্ট্রি অফিসে। জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে প্রবেশের প্রধান ফটকে লেখা এমন সব নীতিবাক্য ও নিষেধ শুধুমাত্র লোক দেখানো। ঠিক যেন প্রদীপের নিচে অন্ধকার। অবাধে চলে সেখানকার ঘুষ-দুর্নীতির কারবার।
একটি সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি যশোর সাব-রেজিস্ট্রি অফিস। চক্রটি এখানে সংঘটিত যত অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করে। অফিসটিতে কর্মরত শামসুজ্জামান মিলন (সম্প্রতি বাঘারপাড়ায় বদলি) ও সাইফুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন এই চক্রের সাথে জড়িত। এদের অবাধ রাজত্ব চলে রেজিস্ট্রি অফিসটিতে। এদের মাধ্যমে প্রতিদিন হাতিয়ে নেয়া হয় লাখ লাখ টাকা। ধরি মাছ না ছুঁই পানি এমনই এক বিশেষ কায়দায় এদের মাধ্যমে ঘুষ আদায় করেন অফিসের কর্তাব্যক্তিরা। সারা বছরে কোটি কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন চলে এই চক্রটির মাধ্যমে।
মহা শক্তিশালী সিন্ডিকেটটির বেধে দেয়া রেটের বাইরে কোন দলিল সম্পাদন হয় না। এই সিন্ডিকেট উপেক্ষা করে কোন মুহুরি (লেখক) দলিল সম্পাদন করতে পারেনা।
রেজিস্ট্রি অফিস সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, একটি হেবা দলিল সম্পাদনে সরকার নির্ধারিত ফিস নেয়ার পরও অফিস খরচের নামে নেয়া হয় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। সম্পত্তির পরিমাণ, শ্রেণি ও মূল্যমান ভেদে এই রেট নেয়া হয়। তবে সরকারি রেট অনুযায়ী হেবা দলিলের ক্ষেত্রে ২০০ টাকার হলফনামা ও রেজিস্ট্রেশন ফি মিলিয়ে খরচ ৬০০ টাকা।
কবলা দলিলের ক্ষেত্রে পৌরসভার জন্য নির্ধারিত রেজিস্ট্রেশন ফি সাড়ে ৮ শতাংশ। এক্ষেত্রে ১ লাখ টাকা দামের দলিলে রেজিস্ট্রেশন ফি সাড়ে আট হাজার টাকা। ওই পরিমাণ টাকা পে-অর্ডারের মাধ্যমে ব্যাংকে জমা দিতে হয়। কিন্তু যশোর সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ হারে টাকা আদায় করা হয়। দলিল লেখকদের অনেকের কাছ থেকে এমন তথ্য পাওয়া যায়। দলিল লেখকদের সাফ জবাব যদি নাম প্রকাশ হয় তা হলে লাইসেন্স বাতিল হবে এবং না খেয়ে মরতে হবে।
যশোরে রেজিস্ট্রি অফিসে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত এই সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিশালী সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে বড় বড় পদস্থরাও তাদের কাছে জিম্মি। এদের ধার্য করা রেটের বাইরে কবলা, হেবা, বন্ধকীসহ কোন দলিল রেজিস্ট্রি হয় না। আর অনৈতিক লেনদেনের ঘটনা যে পুরোপুরি সত্য সেটি স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্যরে বক্তব্যেও উঠে এসেছে।
গত বছর যশোরের মণিরামপুর উপজেলা পরিষদের তথ্য অধিকার দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রতিমন্ত্রী রেজিস্ট্রি অফিসের দুর্নীতির কথা তুলে ধরেন। এ সময় অনুষ্ঠান স্থলের পাশে সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়ের সামনে লেখা ‘আমি ও আমার অফিস দুর্নীতিমুক্ত’ সাইনবোর্ড দেখিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এই লেখা কি মানুষ বিশ্বাস করে? এক সপ্তাহ আগের কথা। আমি নিজে ঘুষের রেট অনুযায়ী টাকা দিয়ে জমির দলিল করিয়েছি। এসব লেখা সাইনবোর্ড দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। আমি বলছি, আজ থেকে এই সাইনবোর্ড যেন আর না থাকে। যদি এই সাইনবোর্ড থাকে, তাহলে দুর্নীতি থাকতে পারবে না।
শক্তিশালী এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস করে না। সাধারণ দলিল লেখকরাও চক্রের কাছে জিম্মি। তাদের নির্ধারিত রেটের বাইরে কোন দলিল লেখক দলিল সম্পাদন করতে পারেনা। চক্র যে রেট নির্ধারণ করবে সেই টাকা দিয়ে যে কোন দলিলের রেজিস্ট্রি করতে হবে। আর সেটি না দিলে কর্তাব্যক্তিরাও দলিলের নিবন্ধন করেন না। এক্ষেত্রে ঘুষ লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে অর্থাৎ চক্রের রেট মাফিক টাকা দেয়া হয়েছে তারও একটি চিহ্ন থাকে দলিলে। সেই চিহ্ন দেখে দলিলের রেজিস্ট্রেশন করেন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তরা। এক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের ধার্যকৃত রেট প্রদাণ হয়ে থাকলে দলিলে পেন্সিল দিয়ে টিক দেয়া থাকে। আর সেটি দেখে সংশ্লিষ্ট কাজে দায়িত্বরতরা বুঝে নেন লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে। অফিস সময় শেষে দলিল গুণে টাকার ভাগ নিয়ে নেন। সন্ধ্যার পর রেজিস্ট্রি অফিস কক্ষে প্রতিদিনকার ঘুষের টাকা ভাগাভাগি হয়।
বছরে প্রায় ২০ হাজারের কাছাকাছি জমির কবলা, হেবা, বন্ধকীসহ অন্যান্য দলিল সম্পাদন হয়। এক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশনের সরকারি রেট দিয়ে কেউ পার পায়না। সিন্ডিকেটের ধার্য করা রেট দিয়ে দলিলের রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। আর বিভিন্ন ধরণের দলিল রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের বেধে দেয়া রেট দিয়েই নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হয়। এভাবে যশোর জেলা ও সদর সাব রেজিস্ট্রি অফিসে কোটি কোটি টাকা ঘুষ বাণিজ্য হয়।
এ বিষয়ে জেলা রেজিস্ট্রার বলেন, দুর্নীতির বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখবো।
আরো পড়ুন:
রেকর্ড রুমে ভুতের আছর!
জিরো থেকে হিরো মিলন-সাইফুল