আনোয়ার হোসেন, মণিরামপুর
যশোরের মণিরামপুরের পোড়াডাঙায় ইউনিয়ন পরিষদ ভবন সংলগ্ন কুলটিয়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র। এ কেন্দ্রে নিরাপত্তা কর্মী ছাড়া কেউ নেই। খেদাপাড়া, হরিহরনগর ও মশ্মিমনগর কেন্দ্রেও একই অবস্থা। এফডব্লিউভির পদ শূন্য দীর্ঘদিন। এসব কেন্দ্রে আয়া বা গার্ডের উপর ভরসা রাখতে হচ্ছে রোগীদের।
নেহালপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিদর্শিকা মাতোয়ারা বানু সপ্তাহে শনি ও মঙ্গলবার সেখানে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন। সকাল ৯টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত কেন্দ্রে রোগীর সেবা দেওয়ার কথা থাকলেও শনিবার দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে সরেজমিনে তাকে পাওয়া যায়নি।
এ কেন্দ্রের নিরাপত্তা কর্মী সিরাজুল ইসলাম বলেন, ৭-৮ মাস এখানে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা (এফডব্লিউভি) নেই। অন্য সব পদও খালি। নেহালপুর থেকে একজন শনি ও মঙ্গলবার আসেন। দুটোর পর হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যায়।
একই অবস্থা নেহালপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের। এখানে তিনদিন গিয়ে এফডব্লিউভি মাতোয়ারা বানুকে পাওয়া যায়নি। সেখানে পাওয়া গেছে শুধু ধাত্রী স্মৃতি মণ্ডলকে। কেন্দ্রের বারান্দায় রাখা হয়েছে ভাঙা চেয়ার- বেঞ্চ। মোবাইল ফোনে মাতোয়ারা বানু বলেন, চার জনের দায়িত্ব একা পালন করা লাগে। বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। এ জন্য ঠিকমত কেন্দ্রে থাকতে পারি না।
কাশিমনগর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের এফডব্লিউভি রিনা মণ্ডল মাতৃত্বকালীন ছুটিতে। এখানে আয়া শেফালি রানি নিয়মিত হাসপাতাল খুলে বসে থাকেন। সপ্তাহে বুধবার ছাড়া এখানে রোগীরা কোন সেবা পাননা। বুধবার হরিদাসকাটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের এফডব্লিউভি বিচিত্রা বিশ্বাস এ হাসপাতালে এসে রোগী দেখেন।
আরও পড়ুন: মামলার অব্যাহতির ভুয়া কাগজ দিয়ে লাখ টাকা আত্মসাৎ মহুরির
শনিবার (২১ জানুয়ারি) বেলা ১১টায় গিয়ে এ কেন্দ্রে ৪-৫ জন রোগী পাওয়া গেছে। ওষুধ না দিয়ে তাদের ফিরিয়ে দিয়েছেন আয়া। এ সময় কথা হয় কোলে ৩ বছরের শিশুকে নিয়ে আসা কাশিমনগর গ্রামের ফিরোজা বেগমের সাথে। তিনি বলেন, ‘আমার আমের (আমাশয়) সমস্যা। ছেলেটার পেটে ব্যথা ও পাতলা পায়খানা। এ জন্য দুজনে ওষুধ নিতি আইছি। বুধবারে আসতে বলল।’
আয়া শেফালি বলেন, এফডব্লিউভি নেই। ওষুধও ফুরিয়ে গেছে। এ জন্য সবাইকে ফিরিয়ে দিচ্ছি।
উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, মণিরামপুরের ১৭টি ইউনিয়নে ১৭টি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে। গর্ভবতী ও প্রসূতি নারী এবং ৫ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের চিকিৎসা সেবার জন্য এ কেন্দ্রগুলো গড়ে উঠেছে। প্রতি কেন্দ্রে রোগীর সেবা ও পরিচর্যার জন্য একজন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা (এফডব্লিউভি), একজন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (সেকমো), একজন ফার্মাসিস্ট, একটি করে আয়া ও অফিস সহায়কের পদ রয়েছে। এরমধ্যে খেদাপাড়া, হরিহরনগর, মশ্মিমনগর ও কুলটিয়া কেন্দ্রে এফডব্লিউভির পদ শূন্য দীর্ঘদিন। এ চার কেন্দ্রে আয়া বা গার্ড ছাড়া কেউ নেই। আর রোহিতা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে একজন সেকমো এবং নেহালপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে একজন ফার্মাসিস্টের পদায়ন রয়েছে। তাদের মধ্যে সেকমো হযরত আলী অসুস্থ হয়ে ছুটিতে আছেন। আর ফার্মাসিস্ট শরিফুল ইসলাম কেন্দ্র ছেড়ে উপজেলা সদর দপ্তরে দায়িত্ব পালন করছেন। বাকি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে এ দুই পদ শূন্য রয়েছে।
এদিকে রোগীর সেবায় সব ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে এফডব্লিউভি এবং সেকমোর জন্য সংযুক্ত কোয়ার্টার থাকলেও ঢাকুরিয়া ও মণিরামপুর স্বাস্থ্য কেন্দ্র ছাড়া কোন কেন্দ্রে এ দুই পদের কেউ কোয়ার্টারে থাকেন না। যারা বাইরে থেকে এসে ডিউটি করেন তাদের অনেকে দেরিতে এসে আগে চলে যান বলে অভিযোগ।
সরেজমিন দেখা গেছে- ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের কোয়ার্টারগুলোতে ময়লা আবর্জনা জমে আছে। কোন কোন কোয়ার্টারে ছাদ ও দেওয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে।
ঢাকুরিয়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের এফডব্লিউভি তাহমিদা আক্তার বলেন, সার্বক্ষণিক আমাদের কোয়ার্টারে থাকার নিয়ম। এখানে থাকার পরিবেশ ছিল না। গত বছর কোয়ার্টার সংস্কার হয়েছে। এখন আমি কোয়ার্টারে থেকে সার্বক্ষণিক সেবা দিতে পারছি।
মনোহরপুরের এফডব্লিউভি সনোকা সিকদার বলেন, আমি ও সেকমো দোতলায় কোয়ার্টারে থাকতাম। সেকমোর বদলি হয়েছে। ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ায় কোয়ার্টারে থাকছি না। নিচে দপ্তরে ঝুঁকি নিয়ে ডিউটি করছি।
ভোজগাতী ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের এফডব্লিউভি সুচিত্রা সরকার বলেন, গর্ভবতী ও প্রসূতি মা এবং শিশুদের সেবা দেওয়া আমাদের কাজ। একসময় নিয়মিত আমাদের এখানে নরমাল ডেলিভারি হতো। গত বছরের নভেম্বর একটা ডেলিভারি করাতে পেরেছি। আর হয়নি। এখন সিজারের দিকে আগ্রহ বেশি।
সুচিত্রা সরকার বলেন, মা ও শিশুদের জন্য অল্পস্বল্প ওষুধ পাই। কিন্তু সাধারণ রোগীরা ওষুধ নিতে আসেন। ওষুদের তুলনায় রোগী বেশি হয়। এ জন্য সবাইকে ওষুধ দিতে পারি না।
মণিরামপুর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরের মেডিকেল অফিসার (এমও) চন্দ্র শেখর কুণ্ডু বলেন, যেখানে এফডব্লিউভির পদ শূন্য সেখানে নিকটবর্তী কেন্দ্র হতে এফডব্লিউভিকে সপ্তাহে দুদিন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কারো দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ পেলে তা গুরুত্বের সাথে দেখা হবে।
চন্দ্র শেখর আরো বলেন, সম্প্রতি সরকার এফডব্লিউভি নিয়োগ দিয়েছেন। আমরা কাউকে পাইনি। ফার্মাসিস্টের নিয়োগ পরীক্ষা হয়েছে। এখনো ফল প্রকাশ হয়নি।
মণিরামপুর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আব্দুস সাত্তার বলেন, কিছু কেন্দ্রে কোয়ার্টার সংস্কার হয়েছে। বাকিগুলো সংস্কারে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কোয়ার্টারে এফডব্লিউভি ও সেকমোদের থাকার জন্য বারবার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। মনোহরপুরে নতুন ভবনের জন্য লিখে পাঠিয়েছি।
আরও পড়ুন: যশোর পাসপোর্ট অফিসে আকস্মিক দুদকের টিম