আবদুল কাদের
যশোর শহরের বেজপাড়া এলাকার বাসিন্দা আবদুর রহমানের বাড়ির টিউবয়েলে গত ২০ দিন ধরে পানি উঠছেনা। পাশের বাড়ির সাবমার্সিবল কল থেকে তিনি প্রতিদিন খাবার পানি সংগ্রহ করে থাকেন। পৌরসভার বারান্দিাপাড়ার বাসিন্দা ইমরুল হাসানও একই কথা জানান। তারা আরও বলেন- শুধু নিজেদের টিউবয়েলে পানি উঠছে না, পৌরসভার সরবরাহ লাইনেও পানি পাচ্ছিনা। বেশিরভাগ সময়ে পানি আসে না। আবার আসলে গতি খুবই কম।
শুধু ওই দুইজনের বাড়ির টিউবয়েলে এ অবস্থা না, যশোর জেলার বেশিরভাগ টিউবয়েলে পানি উঠছেনা। অস্বাভাবিক ভাবে নিচে নেমে যাওয়ায় এ অবস্থা। বিশেষ করে যশোর পৌর এলাকায় চলছে পানির জন্য হাহাকার। শুস্ক মৌসুম না আসতেই এমন পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন শহরের মানুষ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে স্যালো দিয়ে পানি তোলা এবং যত্রতত্রভাবে পুকুর-খালবিল ভরাট হবার কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। সামনে বৃষ্টিপাত না হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে।
যশোর বিএডিসির (সেচ) সহকারী প্রকৌশলী সোহেল রানা জানান, জানুয়ারি মাস থেকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামতে শুরু করে। এপ্রিল মাসে পানির স্তর সর্বোচ্চ নিচে নেমে যায়। তবে এবার একটু আগেভাগেই জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে এসে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। সাধারণত বছরে গড় বৃষ্টিপাত হয় ২০৩ সেন্টিমিটার। তুলনামূলক কম বৃষ্টিপাত হওয়ায় পানির স্তর নামছে। বর্তমানে পানির স্তর ৩২-৩৫ ফুট নিচে নেমে গেছে। একারণে টিউবওয়েলে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে গেছে। ২০২০ ও ২০২১ সালে শুস্ক মৌসুমে নেমেছিল ২৫ ফিটে। আর ২০২২ সালে জানুয়ারি মাসের শেষে নেমেছিল ৩১।
যশোর বিএডিসির (সেচ) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল রশিদ জানান, কৃষিকাজের সেচের কারণেও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায়। এখন চলছে রবি মৌসুম। ভূগর্ভ থেকে গভীর নলকূপ ও স্যালো মেশিনে অপরিকল্পিভাবে পানি উঠানো হয়। বৃষ্টি শুরু হলে পানির স্তর স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তিনি জানান, সাধারণত পানির স্তর স্বাভাবিক থাকে ২০-২৪ ফুটের মধ্যে।
বিএডিসি অফিস (সেচ) সূত্রে জানা যায়, জেলায় গভীর নলকুপের সংখ্যা এক হাজার ৫৬৭টি। এসব নলকূপ দিয়ে ২৫ হাজার ২২৩ হেক্টর জমিতে পানি দেয়া হয়। অন্যদিকে স্যালো টিউবওয়েলের সংখ্যা ৬৩ হাজার ৭৯৩টি। এসব স্যালো টিউবওয়েল দিয়ে একলাখ ২৩ হাজার ৪৮২ হেক্টর জমিতে পানি দেয়া হয়।
এদিকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদ পারভেজ জানান, জেলায় আমাদের ১৯ হাজার ৭৯৬টি অগভীর নলকূপ রয়েছে। সদর উপজেলায় রয়েছে ৫ হাজার ৬২৫টি। এখন পানির স্তর নেমে যাবার কারণে পানি কম উঠছে। আবার অনেক কলে পানি উঠছেনা। যেসব এলাকায় পানির সংকট দেখা দেয়, ওইসব এলাকায় আমরা পক্ষ থেকে গভীর নলকূপ বসিয়ে খাবার পানিসহ গৃহস্থালির কাজে পানির ব্যবস্থা করা হয়। শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকট মোকাবিলার জন্য গভীর নলকূপ বসিয়ে পানির সংকট মোকাবিলা করা হয়। বর্তমানে যশোর পৌর এলাকায় পানির স্তর ৩২ থেকে ৩৫ ফুট নীচে নেমে গেছে। ২৪-২৬ ফুট থাকলে পানি পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন:আয়া-গার্ডে ভরসা চিকিৎসা সেবা
কর্মকর্তারা জানান, আমাদের দেশে বোরো ধান চাষের সময় অনেক পানি অপচয় হয়। এক কেজি ধান উৎপাদন করতে আমাদের দেশে পানি লাগে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার লিটার। উন্নত ধান উৎপাদনকারী দেশ থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে এর অর্ধেক পানি খরচ হয়। এসব দেশে এক কেজি ধান উৎপাদন করতে পানি খরচ হয় এক থেকে দেড় হাজার লিটার। কৃষিকাজে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা পানি অপচয় রোধ করে। বারিড পাইপের মাধ্যমে মাটির নিচ থেকে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে জমিতে পানি দেয়া হয়। আমাদের দেশে জমিতে নালা কেটে পানি দেয়া হয়। ফলে অর্ধেক পানি মাটিতে চুষে নেয়। বোরো ধান চাষের কাজে অনেক পানি অপচয়ের ফলে প্রতিবছরে এ সময় তীব্র খাবার পানির সংকট দেখা দেয়।
পানির অপচয় রোধ করতে ইতোমধ্যে বিএডিসির উদ্যোগে পরীক্ষামূলকভাবে যশোর জেলার বেশ কয়েকটি উপজেলায় উন্নত প্রযুক্তির বারিড পাইপের মাধ্যমে জমিতে পানি দেয়া হচ্ছে। এতে যেমন পানির অপচয় রোধ করা সম্ভব হচ্ছে, তেমনি জমিতে কম সময়ে দ্রুত পানি পৌঁছে যাচ্ছে।
যশোর পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী কামাল হোসেন জানান, তাদের অধীনে ২৩০টি হস্তচালিত নলকূপ ও ২৯টি গভীর নলকূপ রয়েছে। আমাদের ১৪ হাজার ৭শ গ্রাহকের জন্য প্রতিদিন পানির চাহিদা রয়েছে ১৬ হাজার ৩২০ ঘনমিটার। উৎপাদন করা হচ্ছে ২৫ হাজার ৫৮ ঘনমিটার। যার সবটাই সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে পানির স্তর নেমে যাবার কারণে অনেক কলে পানি উঠছেনা। বিশেষ করে বাড়ির কলে পানি পাওয়া যাচ্ছেনা। পানির স্তর ৩২ থেকে ৩৫ ফিট নিচে নেমে গেছে। যে কারণে পানি পেতে কষ্ট হচ্ছে।
এ ব্যাপারে যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের (এমএম কলেজ) ভূগোল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ছোলজার রহমান জানান, প্রতিবছর অপরিকল্পিতভাবে পানি উঠানো হচ্ছে, সেই পরিমাণ পানি ভূগর্ভস্থ পৌঁছাচ্ছেনা। আবার বৃষ্টিপাত কম হচ্ছে প্রতিবছর। যেকারণে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। এটার রোধ করা প্রয়োজন। কৃষি কাজে পরিকল্পিতভাবে পানির ব্যবহার করতে না পারলে সামনে পরিস্থিতির অবনতি হবে।
আরও পড়ুন: হাসপাতালের লুটপাটে লাগাম!