সাজেদ রহমান: বিদ্রোহীরা অস্ত্রাগার ভাঙলেও তারা প্রয়োজনীয় অস্ত্র এবং গুলি সংগ্রহের আগেই আক্রান্ত হন অবাঙালি সৈনিকদের দ্বারা। সকাল ৯টা থেকে টানা ৬ ঘন্টা যুদ্ধ চলার পর বিদ্রোহীদের গুলি ফুরিয়ে আসে। অন্যদিকে যুদ্ধস্থলের উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্বপ্রান্ত ঘিরে থাকা অবাঙালি হানাদারদের অস্ত্র এবং গুলির কোন অভাব ছিল না। ভারি মেশিনগান ছাড়াও তারা ব্যবহার করছিল মর্টার। এ পর্যায়ে ক্যাপ্টেন হাফিজ সিদ্ধান্ত নেন পশ্চিমপ্রান্ত দিয়ে যুদ্ধস্থল ত্যাগ করার। ওই খোলা প্রান্তটি ফাঁকা এবং প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে সেনানিবাসের প্রান্তসীমা ঘেঁষে খিতিবদিয়া গ্রাম। ফাঁকা স্থান যাতে কেউ অতিক্রম না করতে পারে এজন্য ২৫ বেলুচ-এর সৈনিকরা মেশিনগানের সাহায্যে কভার করে রেখেছে। তবুও তুমুল গুলিবর্ষণের মধ্য দিয়ে বিদ্রোহী সৈনিকরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে খিতিবদিয়া গ্রামের দিকে রওনা হন। বিদ্রোহীদের সাথে এ সময় সপ্তম ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সের কিছু সৈনিকও যোগ দেন, যারা ছিলেন বাঙালি। খিতিবদিয়া গ্রামের সমস্ত মানুষ বিদ্রোহী বাঙালি সৈনিকদের স্বাগত জানান এবং তাদের খাদ্য ছাড়াও নিরাপদ স্থানে যেতে সাহায্য করেন। ৩০ মার্চ পুরো রাত তাদের পথেই কাটে। পরদিন সকালে গিয়ে তারা উপস্থিত হন যশোর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে চৌগাছার সীমান্ত ফাঁড়ি মাসিলাতে। মোট দুশ’ জন বাঙালি সৈনিকের মধ্যে ৯ জন ছিলেন জেসিও, আর একমাত্র অফিসার ছিলেন ক্যাপ্টেন হাফিজ।
লেফটেন্যান্ট আনোয়ার, যিনি স্বতঃস্ফুর্তভাবে ক্যাপ্টেন হাফিজের সাথে বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিলেন, তিনি শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছিলেন। সেনানিবাস থেকে বের হবার পথে মেশিনগানের একটি গুলি এসে তাঁর শরীরে বিদ্ধ হয়। কিন্তু চিকিৎসার সুযোগ না থাকায় তাঁর মৃত্যু হয় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে। গ্রামবাসী এবং তাঁর সহযোদ্ধারা মরদেহ নিয়ে যায় নিরাপদ স্থানে। যশোর শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ঝিনাইদহ সড়কের কাজী নজরুল ইসলাম কলেজের পাশে শহীদ আনোয়ারকে সমাহিত করা হয়। ক্যাপ্টেন হাফিজ তাঁর স্মৃতি কথায় লিখেছেন, ‘কুমিল্লার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাঁর জন্ম, শিক্ষক পিতার প্রথম সন্তান তিনি। ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির চ্যাম্পিয়ন অ্যাথলেট। হঠাৎ করেই এই মেধাবী ছাত্রটি পড়াশোনায় ইতি টেনে সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেন। তাঁর রক্তে ভেজা কোমরের বেল্টটা একজন তুলে দিলেন আমার হাতে। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। মনে মনে বললাম, বিদায় বন্ধু, শান্তিতে ঘুমোও তুমি। গতকাল সকালে বলেছিলে কমান্ডিং অফিসারের সামনে বেল্ট খুলে চাকরিতে ইস্তফা দেবে। আজ সেই বেল্ট আমার কাছে, শহীদের রক্তে রঞ্জিত। আমার বেল্টটি খুলে নীরবে শহীদ আনোয়ারের রক্তমাখা বেল্টটি পরে নিলাম।’