-
পণ্যের চড়া দামে ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
-
প্রশাসন মাঠে থাকলেও ব্যবসায়ীরা
চলছে নিজস্ব গতিতে
রায়হান সিদ্দিক
সিয়াম সাধনার মাস রমজান। এ মাসটি হচ্ছে সহনশীলতা প্রদর্শনের মাস। তবে এমাসেই যেন বেশি অসহনশীল হয়ে ওঠে প্রায় সব পণ্যের দাম। বিগত দিন থেকে এবছর আরও বেশি চোখরাঙানি দিচ্ছে দ্রব্যমূল্য। সারাদেশের মতো যশোরের বাজারেও উত্তাপ ছড়াচ্ছে দ্রব্যমূল্য। গত রমজানের চেয়ে এবার প্রায় দ্বিগুণ দ্রব্যমূল্য।
এদিকে বাজার নিয়ন্ত্রণে থেমে নেই প্রশাসন। তারা নিয়মিত বাজারে অভিযান চালাচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের করছে জরিমানাও। কিন্তু ব্যবসায়ীরা চলছে তাদের গতিতে। পণ্যের চড়া দামে ক্ষুব্ধ ক্রেতারা।
বাজার তথ্য বলছে, এখন খোলা চিনির দাম ১১৫-১২০ টাকা কেজি ছুঁয়েছে, যা গত বছরের রমজানে ছিল ৮০ টাকার মধ্যে। অর্থাৎ, চিনির ক্ষেত্রে ভোক্তার খরচ বেড়েছে ৪৮ শতাংশ। যদিও সরকার নির্ধারিত চিনির দাম ১০৭ টাকা, কিন্তু এ দামে ক্রেতারা কিনতে পারছেন না কোথাও। একই অবস্থা সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রেও। খোলা সয়াবিন ১৮৬ থেকে ১৯২ টাকা লিটার দরে বিক্রি হচ্ছে, যা গত রমজানে ১৪০ টাকার কমে পাওয়া যেত। বোতলজাত সয়াবিনের দাম প্রায় একই সময়ের ব্যবধানে ২০ টাকা বেড়ে এখন ১৯৫ থেকে ১৯৮ টাকায় কিনতে হচ্ছে। অর্থাৎ, দাম বেড়েছে ১০ শতাংশের বেশি।
বৃহস্পতিবার যশোরের বড় বাজার, রেলগেট বৌ বাজার, বারান্দীপাড়া বৌ বাজার ঘুরে দেখা যায় দফায় দফায় ক্রেতাদের সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। এমনই একজন ক্রেতার সাথে কথা বলে জানা যায়, গত পরশু দিন বাজার থেকে শসা কিনেছিলেন ৪০ টাকা কেজি দরে, আজ সেই শসার দাম ১শ টাকা কেজি। খোয়া ভাঙ্গা মেশিন চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন শহরের রেলগেট এলাকার সেই বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন। রাগে ক্ষোভে শসা না কিনেই ফিরে গেলেন তিনি।
বাজার করতে আসা শহরের খালধার রোড এলাকার বাসিন্দা মাসুদ মোল্লা পেশায় একজন শিক্ষক। তিনি জানান, সারা বিশ্বে রমজান মাসে যখন পণ্যের দাম কমিয়ে দেয় ব্যবসায়ীরা, তখন বাংলাদেশে সকল পণ্যের দাম দেড় থেকে দুই গুণ বেড়ে যায়। যার যাতাকলে পড়ে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত আয়ের সাধারণ মানুষেরা পিষ্ঠ হচ্ছে। তিনি বলেন, এক সপ্তাহ আগে ৩০-৪০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে বেগুণ। এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা।
বড় বাজারের তরকারি ব্যবসায়ী আলামিন বিশ্বাস বলেন, আমরা খুচরা ব্যবসায়ী পাইকারের কাছ থেকে যে দামে পণ্য ক্রয় করি, খরচ বাদ দিয়ে কিছু লাভ রেখে বিক্রি করি। এখন আমরা বেশি দামে কিনে তো আর কম দামে বিক্রি করতে পারি না, তাহলে আমদের সংসার চলবে কিভাবে! তিনি আরও বলেন, একে তো বেশি দামে সবজি কিনে বিক্রি করতে হচ্ছে। অন্যদিকে বেশি দামের কারণে ক্রেতাদের সাথে ঝামেলা হচ্ছে।
সরেজমিনে যশোরের বেশ কিছু বাজার ঘুরে ক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রয়োজনের থেকে কম পণ্য কিনছেন ক্রেতারা। শহরের বারান্দীপাড়া এলাকার ইফতেখার রহমান জানান, প্রতি রমজানে ১৫ দিন করে দুই দফায় মাসিক বাজার করেন তিনি। কিন্তু এবছর সকল পণ্যের দাম অন্যবছরের তুলনায় বেশি হওয়ায় তিন দিন চলবে এমন বাজার করেছেন। তিনি আরও জানান, এভাবে চলতে থাকলে রমজানে দিনের পাশাপাশি রাতেও রোজা থাকতে হবে।
চলতি বছরে গত এক দেড় মাস ধরে রোজায় বেশি ব্যবহৃত পণ্য খেজুর, ছোলা, ডাল, চিনি ও সয়াবিন তেলের দাম বাড়তি। একই সঙ্গে বেড়েছে মাছ, মাংস, ডিম, বিভিন্ন ধরনের ফল ও ইফতারের অন্য উপকরণের দামও। বাজার ঘুরে দেখা যায়, ছোলা কেজি দরে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা, চিড়ে ৬০ টাকা, বেশন ১শ টাকা ও প্যাকেট ট্যাংক ৫শ গ্রাম ৩৪০ টাকা।
আবার বাজারে ভালো মানের কোনো খেজুর ৪শ টাকার নিচে কেনা যাচ্ছে না। আমিরাতের নাগাল, দাবাস ও লুলু খেজুরের দাম ৬শ টাকা ছাড়িয়েছে। আর সৌদি আরবের আজওয়া, আম্বার কিংবা জর্ডানের মরিয়ম খেজুর কিনতে হলে গুনতে হচ্ছে হাজার টাকার বেশি। কেজিতে এগুলো যে পরিমাণে ধরে তাতে একটি খেজুরের দাম পড়ে ৮ থেকে ১৬ টাকা পর্যন্ত।
বেড়েছে সব ধরনের আমদানি ফলের দামও। বাজারে মানভেদে আপেলের দাম ২শ ৫০ থেকে ৩শ ২০ টাকা, গত বছর ছিল ১শ ৫০ থেকে ২শ ৩০ টাকা। বিভিন্ন ধরনের মাল্টা ও কমলা মিলছে ২শ থেকে ৩শ টাকায়, গত বছর যা ছিল ১শ ৪০ থেকে ২শ ২০ টাকার মধ্যে।
অন্যদিকে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ৩০ টাকা। এখন ব্রয়লার মুরগির দাম সর্বকালের সর্বোচ্চ। রমজান শুরুর কারণে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়তে বাড়তে এখন প্রতি কেজি প্রায় স্বাভাবিক দামের চেয়ে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। মাসখানেক আগেও প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। এখন ২শ ৬০ থেকে ২শ ৯০ টাকা।
বর্তমান বাজারদর নিয়ে জানতে চাইলে বড় বাজারের সাহা স্টোরের গোবিন্দ সাহা বলেন, রোজার মাসে ভ্রাম্যমাণ আদালতের পাশাপাশি সমালোচনা এড়াতে কোম্পানিগুলো রমজানের অনেক আগেই দাম বাড়িয়ে রেখেছে। রমজানের পণ্যের দাম বিগত সব সময়ের মধ্যে বেশি।
সরবরাহ কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপাতত কোনো পরিবেশক প্যাকেট চিনি দিচ্ছে না। একটি-দুটি কোম্পানি ছাড়া কারও কাছে তেল নেই। পাইকারি বাজারেও কিনতে হচ্ছে বাড়তি দামে।
এদিকে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত ১৯ মার্চ যশোরের বাজারে অভিযান চালায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসময় খাবার অযোগ্য মাংস বিক্রির অভিযোগে একজনকে জরিমানা ও মাংস ফেলে দেয়া হয়। পাশাপাশি মুদি দোকান, কাঁচা বাজার, মাছ বাজার, মরগির বাজার ও গরুর মাংশের বাজারে গিয়ে দ্রব্যমূল্যের তদারকি করা হয়। এসময় সকলের মূল্য তালিকা প্রদর্শন ও বাড়তি মূল্য না নেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। অভিযানের নেতৃত্ব দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট একেএম আবু নওশাদ। বাজার তদারকির বিষয়ে তিনি জানান, সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী প্রতি জেলায় বাজার তদারকির জন্য প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, পৌরসভা, ভোক্তা অধিকার, স্বাস্থ্য বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের যৌথ টিম কাজ করছে। ইতিপূর্বে বাজার নিয়ন্ত্রণ রাখতে অভিযান চালানো হয়েছে। রমজানের ভেতরেও বাজার যাতে স্বাভাবিক থাকে তার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
১ Comment
Pingback: ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়ে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা প্রধানমন্