নিজস্ব প্রতিবেদক
বারবার ছাত্রলীগের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় (যবিপ্রবি)। ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারে শিক্ষার্থী হত্যা, চাঁদাবাজি, র্যাগিং, নির্যাতন ও ডাকাতির মতো ঘটনা থেকেও বাদ যায়নি যবিপ্রবি ছাত্রলীগ। সর্বশেষ পাঁচ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে সহপাঠীকে আটকে রেখে নির্যাতনের ঘটনায় আবারও সমালোচনা ও নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হয়েছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছাত্রলীগের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে কার্যত দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না দেয়ায় বারবার এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। তবে ছাত্রলীগ বলছে, ব্যক্তির দায় কখনো ছাত্রলীগ নিবে না। আর বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, অতীতের চেয়ে নেতিবাচক ঘটনা কমেছে।
যবিপ্রবি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে ইসমাইল হোসেন নামে এক ছাত্রকে রোববার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ উঠে। রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মশিয়ুর রহমান হলের ৫২৮ নাম্বার কক্ষ থেকে অচেতন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের ভর্তি করা হয়। ভুক্তভোগী ইসমাইল ময়মনসিংহ জেলার বলারামপুর গ্রামের আব্দুল মান্নানের ছেলে। তিনি যবিপ্রবির পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। অভিযুক্ত যবিপ্রবির কম্পিউটার ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের সালমান এম রহমান ও সোয়েব আলীকে বিশ^বিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিস্কার করা হয়েছে। এছাড়া তাদের কাম্পাসে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। একই সাথে তদন্ত কমিটি গঠন, মামলা দায়ের ও ভিকটিমের নিরাপত্তা নিশ্চিতের উদ্যোগ নিয়েছে বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন।
চাঁদা দাবিতে এবার শিক্ষার্থীকে আটকে রেখে পাঁচ ঘণ্টা নির্যাতন
দুই ছাত্রলীগকর্মীকে বহিস্কার ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ইসমাইল হোসেন জানান, শহরের পালবাড়ি ভাস্কর্য মোড়ে একটি ছাত্রাবাসে থাকেন। বিভিন্ন সময়ে তার কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে আসছিলেন কম্পিউটার ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সোয়েব আলী ও সালমান এম রহমান। ইসমাইল দিতে অস্বীকার করলে রোববার দুপুরে ডিপার্টমেন্টে ক্লাস চলাকালীন সময়ে সোয়েব ও সালমান তাকে ডেকে শহীদ মশিয়ুর রহমান হলে নিয়ে যায়। সেখানে ইসমাইলকে বেঁধে রেখে রড, পাইপ আর বেল্ট দিয়ে নির্যাতন করে।
আরও পড়ুন:সাড়া নেই বৈকালিক চেম্বারে তিন দিনে ৬ রোগী, পাওয়া গেল না চিকিৎসক
বিশ্ববিদ্যালয়ের এপিপিটি বিভাগের মাস্টার্স শিক্ষার্থী আল জুবায়ের রনি জানান, ইসমাইল কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত না। রোববার দুপুরের পর থেকে ইসমাইলকে পাওয়া যাচ্ছিলো না। এমনকি তার ফোনও বন্ধ ছিলো। সে রোজা ছিলো, ইফতারের সময় ইসমাইলকে না পাওয়ায় অনেক খোঁজাখুঁজি করা হয়। ওর সহপাঠীরা জানায়, হলের সালমান আর সোহেব ক্লাস চলাকালীন সময়ে ডেকে নিয়ে গেছিলো, তারপর আর খোঁজ নেই ইসমাইলের। পরে আমরা সবাই হলে যেয়ে খুঁজে দেখি ৫২৮ নাম্বার কক্ষে অসচেতন অবস্থায় পড়ে রয়েছে। প্রথমে ক্যাম্পাসে প্রাথমিক চিকিৎসা এবং পরে অবস্থার অবনতি হওয়াতে যশোর হাসপাতালে ভর্তি করি। শিক্ষার্থীরা জানান, হলের ৫২৮ নম্বর কক্ষটি ৬ জনের থাকার ব্যবস্থা থাকলেও ছাত্রলীগকর্মী সোয়েব আর সালমান দুজনই থাকতেন। এমনকি গাঁজা সেবন ও ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খলা করার দায়ে সোয়েব বহিষ্কার হওয়ার পরেও ছাত্রলীগের প্রভাবে হলে নিয়মিত বাসিন্দা তিনি। এমনকি এর আগেও এই দুজনের বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্রদের শিবির উপাধি দিয়ে চাঁদা দাবি করারও অভিযোগ তুলেছেন সাধারণ শিক্ষার্থী। তারা দুজনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ শাখার সভাপতি সোহেল রানার অনুসারী হিসেবে পরিচিত। এদিকে নির্যাতনকারী ছাত্রদের বিচারের দাবিতে রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে মানববন্ধন করেন পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষার্থীরা। মানববন্ধনে এ ঘটনায় জড়িত ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার ও শাস্তির দাবি জানান। একই দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির পক্ষ থেকেও একই স্থানে মানববন্ধন করা হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সোহেল রানা বলেন, যবিপ্রবি ছাত্রলীগে সভাপতি-সম্পাদকের আলাদা কোন গ্রুপ নেই। ফলে আমার অনুসারী হওয়ার সুযোগও নাই। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা ছাত্রলীগের কোন পদে নেই। তারা কর্মী হিসেবে ছাত্রলীগের মিটিং মিছিলে অংশ নিতে পারে। একজন কর্মী অপরাধ করলে তার দায় তো সংগঠন বহন করবে না। সোমবার এক নোটিশে শহীদ মশিয়ুর রহমান হলের প্রভোস্ট ড. মো.আশরাফুজ্জামান জাহিদ জানান, অভিযুক্ত সোয়েব আলী ও সালমান এম রহমানকে হল থেকে সাময়িক বহিস্কার করা হয়েছে। এর আগে রোববার রাতে শহীদ মশিয়ুর রহমান হলের প্রভোস্ট ড. মো.আশরাফুজ্জামান জাহিদ বলেন, ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর সহপাঠীরা উদ্ধার করে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। ভর্তি করার আগে তার মুখ দিয়ে নির্যাতনের বর্ণনা শুনেছি। ইসমাইলের ভাষ্য, চাঁদার দাবিতে তাকে আটকে রেখে সন্ধ্যা পর্যন্ত নির্যাতন চালানো হয়েছে। আমরা নির্যাতনের কক্ষটি সিলগালা করে দিয়েছি।
এর আগেও গেল বছরের ১৬ অক্টোবর যবিপ্রবিতে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। যবিপ্রবির শহীদ মসিয়ুর রহমান হলে ছাত্রলীগের সভাপতি সোহেল রানা ও সাধারণ সম্পাদক তানভীর ফয়সালের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়। ২০১৪ সালের ১৪ জুলাই দুপুরের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী নাইমুল ইসলাম রিয়াদকে কুপিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এই মামলায় ১১ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা। ২০১৭ সালের ৫ অক্টোবরে যবিপ্রবির শহীদ মসিয়ুর রহমান হলে তৎকালীন শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম হাসানের নেতৃত্বে হল ডাকাতির ঘটনার ঘটে। এ সময় শিক্ষার্থীদের প্রায় ৩০০ ফোন, ১০০ ল্যাপটপ, নগদ অর্থসহ ডাকাতি হয়। ঘটনার তিন পর ৮ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি সুব্রত বিশ্বাস ২৫ জনের নামে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছাত্রলীগের বিশৃঙ্খলা কর্মকাণ্ডের পরেই শুধুমাত্র সাময়িক বহিস্কারের মধ্যে শাস্তিতেই সীমাবদ্ধ বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় না আনাতে বারবার এমন কর্মকাণ্ডের শিরোনাম হচ্ছে ছাত্রলীগের এই শাখাটি। তবে ছাত্রলীগের এমন কর্মকাণ্ডে ব্যক্তিগত সংগঠন নিতে পারে না দাবি শাখাটির সভাপতি সোহেল রানার।
যবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, অভিযুক্ত দুইজনকে বিশ^বিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিস্কার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিশ^বিদ্যালয়ের প্রভোস্টকে থানায় মামলা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সাথে প্রভোস্ট বডি আগামি সাতদিনের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিবে। এছাড়াও নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য প্রভোস্ট ও প্রক্টরিয়াল বডিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিশৃঙ্খলাকারীদের স্থান নেই। সেটা ওকান ছাত্রলীগ বা অন্য কোন সংগঠন হোক। কলেজ প্রশাসন এখানে পাঠদান ঠিক রাখতে সবার উপর আইন সমান।
আরও পড়ুন:বেনাপোল বন্দর দিয়ে দ্বিতীয় দিনেও ভারতে রপ্তানি বন্ধ

 
									 
					