নেপথ্য কারণ নারীর কাজের গতি
সরকারের তদারকি
সুনীল ঘোষ: কাজের গতি, শ্রম নীতিমালা ও সরকারের তদারকিতে কমে আসছে নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য। তবে এখনো প্রতিনিয়ত সংগ্রাম ও নানামুখি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে নারীর।
কথাগুলো ইমারত নির্মাণ শ্রমিক বীথির। ছেড়ে গেছে স্বামী, ভেঙে গেছে সংসার, কিন্তু অটুট ছিল তার মনোবল। কপালে সয়নি দাম্পত্য সুখ। দ্বিতীয় বিয়ের কথাও ভাবেননি। মনে কখনো উকিও মারেনি। একমাত্র পুত্র জীবনকে বুকে জড়িয়ে পার করে দিয়েছেন জীবনের অনেকটা বছর। সন্তানের ভবিষ্যৎ ভাবনা তাকে করেছে সংগ্রামী। মধ্যবয়সেও পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে ইমারত নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করছেন বীথি বেগম। অতিপরিশ্রম ও প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব তাকে করেছে হাড্ডিসার, কিন্তু কমেনি কাজের গতি।
শনিবার বিকেল তখন সাড়ে ৩টা। পড়ন্ত বিকেলেও ছিল প্রখর রৌদ। যশোর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন মাঠে চলছিল ঢালাইয়ের কাজ। এ সময় নজরে পড়ে বেশ কয়েকজন পুরুষ শ্রমিকের সাথে জোরগতিতে বেলচা চালাচ্ছেন এক নারী। পাথর-বালু সিমেন্টের গোলা কড়াইভর্তি করে তুলে দিচ্ছিলেন অপর শ্রমিকের মাথায়।
কংক্রিটে গড়া হচ্ছে স্টেশন চত্বর। অনেক মানুষের জটলা। এগিয়ে দেখা যায় ৪-৫ জন পুরুষ শ্রমিকের সাথে পাল্লা দিয়ে কড়াই ভরছেন এক মধ্যবয়সী নারী। তার কাজের গতি এমনি ছিল, যা দেখতেই জমেছিল মানুষের ভিড়। ঘাম গড়িয়ে পড়ছিল ঢালাইভর্তি কড়াইয়ে। কিছুক্ষণ পর ক্লান্ত দেহে তাকে যেতে দেখা যায় টিউবওয়েলের দিকে। এগিয়ে দেখা যায় দু-হাতভরে পান করছেন পানি।
এই সুযোগে কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, বাড়ি যশোর সদরের মনোহরপুর গ্রামে। একমাত্র পুত্র সন্তান জীবন ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর ছেড়ে যায় স্বামী সাইফ। সে রিকশা চালায়। ৭ বছর ধরে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করছি। ছেলের বিয়ে হয়েছে। তবু কায়িক পরিশ্রমের কাজ ছেড়ে যাইনি। ঘাম বিক্রির ৬০০ টাকায় সংসার চলে।
পুরুষ শ্রমিকের চেয়ে তার মজুরি কম কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, দিন বদলেছে। এখন নারী-পুরুষের সমান মজুরি।
যশোর সদর উপজেলা শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রে জানা যায়, যশোরে ১৮ হাজারের বেশি নির্মাণ শ্রমিক আছে। এর মধ্যে সদরে সাড়ে ৪ হাজার, মণিরামপুরে দুটি ট্রেড ইউনিয়নে ২ হাজার ৬০০, কেশবপুরে আড়াই হাজার, অভয়নগরে ১ হাজার ৩০০ চৌগাছায় দেড় হাজার, ঝিকরগাছায় দেড় হাজার ও বাঘারপাড়ায় ২ হাজার ইমারত শ্রমিক আছে।
এর মধ্যে প্রায় ৩০ ভাগ নারী। বছর কয়েক আগে মজুরি বৈষম্য ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে সেই অবস্থার।
নির্মাণ শ্রমিক নেতা শাহীন মাহমুদ জানান, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন চাকরি, ব্যাংক, কৃষি, ব্যবসায়িক উদ্যোগসহ নানা ক্ষেত্রে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছে নারী। নারীর প্রতি বৈষম্য কমাতে সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে কাজ করছে। তিনি বলেন, শুধু শ্রমিকই না, ব্যবসার জন্য কম সুদে ও সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থাসহ নানা কারণে নারীরা বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
তবে বিভিন্ন পর্যালোচনায় দেখা যায়, সর্বক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়নে সরকার কাজ করছে। কিন্তু হয়রানী ও সহিংসতা পুরোপুরভিাবে রোধ করা যায়নি।
২০২১ সালের মার্চে হার্ভার্ড বিশ^বিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়া ইন্সটিটিউট ও মিত্তাল ফাউন্ডেশনের ‘৫০ বছরে বাংলাদেশ : ফিরে দেখা ও ভবিষ্যৎ’ শিরোনামের অনলাইন আয়োজনের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে নারী শিক্ষার হার ও ঘরে-বাইরে কাজে অংশগ্রহণ বাড়লেও নারীর নিরাপত্তা ও মজুরি বৈষম্য এখনো কাক্সিক্ষত পর্যায় আসেনি। সেখানে বলা হয়েছে-বৈশি^ক মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবকালে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে। মজুরি বৈষম্যের প্রধান কারণও জেন্ডার। ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে বৈষম্য এবং সহিংসতাকে প্রতিহত করতে নারীদের কৌশলী হতে হয়েছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে নারীরা সামনে এগিয়ে এসেছে ঠিকই, কিন্তু তারা প্রকৃত মুক্তি ও ন্যায় বিচার পাচ্ছেন কি-না তা আলোচনার বিষয়। এই বৈষম্য ও সহিংসতা টেকসই উন্নয়নের অভিষ্ঠ লক্ষ্য অর্জন, মধ্যম আয়ের মর্যাদা লাভ ও লিঙ্গ বৈষম্যের চ্যালেঞ্জকে দিন দিন বাড়িয়ে তুলছে।
বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আতিকুর রহমান জানান, সর্বশেষ ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে নারীর ক্ষমতায়ন, সম-অধিকার ও সমান সুযোগ নিশ্চিতকরণ ১৯৯৭ সালে প্রণীত নারী উন্নয়ন নীতিমালা পুনর্বহাল করার অঙ্গীকার করে। সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি, ২০১১ প্রণয়ন করেছে।
তিনি বলেন, নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য রোধে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সদিচ্ছা থাকতে হবে। তাহলেই বীথি বেগমরা রাষ্ট্র ও সামাজিক জীবনে মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারবে। বীথি বেগমের ত্যাগ ও অটুট মনোবল অন্যান্য খাতে নিয়োজিত নারী শ্রমিকদের অনুপ্রেরণা যুগাবে বলেও মনে করেন এই নেতা।