নিজস্ব প্রতিবেদক: পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতির (পুনাক) সভানেত্রী জীশান মীর্জার মহানুভবতায় চাকরি পেলেন যশোরের ঝিকরগাছার শিমুলিয়া গ্রামের মেয়ে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে মাস্টার্স পাস করা শারীরিক প্রতিবন্ধী শাহিদা খাতুন। দেশের শীর্ষ আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান যশোরের নওয়াপাড়াস্থ আকিজ জুট মিলে এক্সিকিউটিভ অফিসার পদে চাকরি হয়েছে তার। প্রতিবন্ধীতাকে জয় করে অনন্য নজির স্থাপনকারী শাহিদার কর্মসংস্থান উপলক্ষে বুধবার তার বাড়ি ঝিকরগাছার শিমুলিয়া গ্রামে পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতি (পুনাক) যশোর জেলা এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে শাহিদার হাতে চাকরির নিয়োগপত্র তুলে দেন পুনাক সভানেত্রী জীশান মীর্জা। এর আগে, শাহিদার পরিচালিত প্রতিবন্ধী শিশু ও নারীদের নিয়ে ‘সৃষ্টিশীল নারী প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থার’ শিশুদের সাথে কথা বলেন। এসময় অনেক প্রতিবন্ধী শিশুদের বুকে জড়িয়ে ধরে আদর আর কপালে চুমু দেন। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের খোঁজ খবর নেয়ার সাথে তাদের চকলেট, নতুন পোশাক ও বিভিন্ন উপহার তুলে দেন।
দুটি পা ও একটি হাত না থাকা শারীরিক প্রতিবন্ধী শাহিদা খাতুন মুদি দোকানি রফিউদ্দিনের ছয় সন্তানের মধ্যে চতুর্থ। দুটি পা আর একটি হাত না থাকলেও সচল বাকি হাত দিয়েই বাঁচার স্বপ্ন দেখেন শাহিদা খাতুন। প্রতিবন্ধিতাকে জয় করে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন এলাকায়। জন্ম থেকে প্রতিবন্ধী তরুণী প্রবল ইচ্ছাশক্তির ওপর ভর করে ২০১৫ সালে যশোর সরকারি এম এম কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স পাস করেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি শাহিদা হ্যান্ডিক্রাফট, সেলাইসহ বিভিন্ন হাতের কাজও করতে পারেন। নিজে প্রতিবন্ধী হয়েও অন্য প্রতিবন্ধীদের জন্য এগিয়ে আসেন তিনি। বাড়ির পাশে গড়ে তোলেন সৃষ্টিশীল নারী প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থা। ওখানেই প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা আর নারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গড়ে তুলছেন আত্মকর্মজীবী। একসময় প্রতিবেশীরা শাহিদার জন্মকে ‘পাপের ফল’ বলতেও কার্পণ্য করেনি। আজ তারা শাহিদাকে মেনে নিয়েছেন বিপদের বন্ধু হিসেবে। যেকোনো দরকারে ছুটে আসেন তারা শাহিদার কাছে। তার পরেও ইচ্ছাশক্তি বলে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও চাকরি না পাওয়ায় হতাশ ছিলেন শাহিদা। বিভিন্ন গণমাধ্যমে শাহিদাকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পরে পুনাকের সভানেত্রী জীশান মীর্জার নজরে আসলে তার আন্তরিকতায় পুলিশ শাহিদার বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া শুরু করে। ২২ মার্চ ও ২৩ মার্চ যশোর জেলা পুলিশ সমাবেশ ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় যশোর আসলে বুধবার জেলা পুনাক নেতৃবৃন্দদের সাথে নিয়ে শাহিদার সাথে দেখা করে চাকরির নিয়োগপত্র তুলে দেন।
নিয়োগপত্র পেয়ে খুশিতে আত্মহারা শাহিদা খাতুন। তিনি বলেন, অবশেষে আমার একটা কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। পড়াশুনা শেষ হয়েও চাকরি না হওয়ায় আমি খুব দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। প্রতিবন্ধী হিসাবে বাড়িতে পরিবারের কাছে বোঝা হিসাবে ছিলাম। তার পরে লেখাপড়া শেষ করেই আরো বোঝাটা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। পুনাকের সভানেত্রীর কল্যাণে আমার একটা চাকরি হলো। এখন আমার মা-বাবার পাশে দাঁড়াতে পারবো। তারা যে আমাকে সীমাহিন শ্রম দিয়ে গড়ে তুলেছেন চাকরি হওয়ার ফলে এখন আমি তাদের দুমুঠো ভাত খাওয়াতে পারবো; সেটা আমার জীবনে বড় পাওয়া। আমি চাকরিতে যোগদান করলেও আমার হাতে গড়া সৃষ্টিশীল নারী প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থা চলবে তার নিজস্ব গতিতে। কেননা আমি প্রতিবন্ধী ভাই বোনেদের মধ্যে দিয়ে সামনে নেতৃত্ব দেয়ার মতো অনেকেই গড়ে তুলেছি।
পুনাক সভানেত্রী জীশান মীর্জা সাংবাদিকদের বলেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে শাহিদাকে নিয়ে সংবাদ পড়েছি। তিনি বলেন, শাহিদা একজন হার না মানা মানুষ। তিনি এখন তার মেধা দিয়ে প্রতিবন্ধীদের মধ্যে আলো ছড়াচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর দেখানো পথ অনুসরণ করে বাংলাদেশ পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতি নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি অসহায় ও দুস্থদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। সেই ধারাবাহিকতায় শাহিদার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে পুনাক। উচ্চ শিক্ষিত হয়েও তিনি চাকরি পাচ্ছেন না। শাহিদার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হওয়ায় পরিবারটি এখন ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। উচ্চ শিক্ষিত আর প্রতিবন্ধীকতা জয় করে চাকরি না পাওয়ায় হতাশ ছিলেন শাহিদার বাবা মুদিদোকানি রফিউদ্দিন। অবশেষে পুনাকের সভানেত্রী জীশান মীর্জার সহায়তায় শাহিদার চাকরি হওয়ায় খুশি তিনি।
প্রথমেই পুনাকের সভানেত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, শাহিদার জন্মের পর অনেকে অনেক কটু কথা বলেছে। অনেকে মেরে ফেলতেও বলেছে। তারপরও অনেক কষ্ট করে বড় করেছি। তার কত রোদ, বৃষ্টি, ঝড় পার করে আজ সে উচ্চ শিক্ষিত। দীর্ঘদিন পরেও হলেও শাহেদা চাকরি পেয়েছে এটা সমাজের অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। শাহিদাকে সমাজের আর দশটা প্রতিবন্ধী ছেলে-মেয়েও তাকে অনুসরণ করতে পারবে। তারাও লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে, সমাজের বোঝা হবে না।
শাহিদার পিতা রফিউদ্দিন তার মেয়েকে নিয়ে চাকরির বিষয়ে যশোর সংবাদপত্র পরিষদের সভাপতি ও দৈনিক কল্যাণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা একরাম-উদ-দ্দৌলার কাছে আসেন। তার মেয়েকে নিয়ে সংবাদপত্রে প্রতিবেদন ছাপিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের অনুরোধ করেন। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিয়ে গত ২ বছর ধরে তিনি শাহিদার জন্য জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ বিভিন্ন দফতরে যোগাযোগ করেছেন। একই সাথে দৈনিক কল্যাণসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে শাহিদার বিষয়ে খবর প্রকাশ হলে আইজিপির সহধর্মীনির চোখে পড়ে খবরটি। গত ১৩ জানুয়ারি যশোরের পুলিশ সুপারের মাধ্যমে তিনি শাহিদার সাথে যোগাযোগ করেন। অবশেষে তিনি নিজ উদ্যোগে প্রতিবন্ধী শাহিদার কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেন। শাহিদার চাকরি হওয়ায় একরাম-উদ-দ্দৌলা সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, আপাতত মেয়েটির চাকরি হলেও সরকার যেন তার পাশে থাকে। তার জন্য বিশেষ কোটায় সরকারি চাকরির ব্যবস্থা নেবার অনুরোধ জানান।