কল্যাণ ডেস্ক
চলতি বছরের ১৮ মার্চ। ভারতের উত্তরাঞ্চলের শহর প্রয়াগরাজ; যা পূর্বে এলাহাবাদ নামে পরিচিত ছিল। শহরটিতে সেদিন দুটি পরিবারের মাঝে ঘটে যায় ভয়ংকর এক ট্র্যাজেডি। যার ফলশ্রুতিতে তিন জনকে হত্যা করা হয় এবং সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়।
শিবানী কেশরওয়ানি বলেন, “রাত ১১টার দিকে প্রায় ৬০-৭০ জন লোক আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হয়। তারা আমাদের নির্দয়ভাবে মারতে শুরু করে।”
শিবানী জানান, ঐ লোকগুলো ছিল আংশিকার পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়রা। যিনি তার ভাই আংশুর স্ত্রী। তাকে এরও একঘণ্টা আগে কেশারওয়ানি বাড়িতে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।
শিবানী ও পুলিশ বলছে, আংশিকা আত্মহত্যা করে মারা গেছে। তবে তার পরিবার এবং প্রতিবেশীরা অভিযোগ, তাকে যৌতুকের জন্য হত্যা করা হয়েছে।
কেশারওয়ানিদের কাঠের ব্যবসা ছিল এবং তারা যৌথ পরিবারে বসবাস করত। তাদের বাড়ির নিচতলা ও বেসমেন্টে দোকান, গুদাম ছিল। আর উপরতলায় পরিবারের সকলে বাস করত। প্রতিটি তলায় একটি করে বেডরুম ছিল। এক বছর আগে তাদের বিয়ের পর থেকে আংশু তার স্ত্রীর সাথে একদম উপরের তলায় থাকতেন। আর তার বাবা-মা প্রথম তলায় থাকতেন। আর তার বোন শিবানী ছিল দ্বিতীয় তলায়।
শিবানী বিবিসিকে বলেন, “আনশিকা সাধারণত রাত ৮টার দিকে ডিনারের জন্য নেমে আসে। কিন্তু সেদিন তাকে দেখা যাচ্ছিল না। আমরা ভেবেছিলাম সে নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে।”
শিবানী জানান, রাত ১০টায় তার ভাই দোকান থেকে উপরে উঠে আসে। এরপর সে তার স্ত্রীকে ডাকতে উপরে চলে যায়।
শিবানী বলেন, “স্ত্রীকে ডেকে যখন উত্তর পাওয়া গেল না তখন আমার ভাই দরজার উপরে একটি কাচের ফলক ভেঙে তালাটি খুলে ফেললেন। তখন তিনি আনশিকাকে মৃত দেখতে পান। এইসময় তিনি চিৎকার করে উঠলেন এবং আমরা সবাই ছুটে গেলাম।”
আংশু ও তার চাচা তাদের বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটারেরও কম দূরে থানায় মৃত্যুর খবরটি জানান। একইসাথে আংশিকার মা-বাবাকেও মৃত্যুর খবর জানানো হয়েছিল।
ঘটনার এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে আনশিকার পরিবার তাদের কয়েকডজন আত্মীয়দের সাথে নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই দুই পরিবারের মধ্যে বেশ বাজেভাবে সংঘর্ষ হয়।
সেক্ষেত্রে শিবানি তার মোবাইল ফোনের ধারণকৃত ভিডিওতে দেখায়, পুরুষরা চিৎকার করছে। একে অপরকে কাঠের লাঠি দিয়ে আঘাত করছে। একজন পুলিশ মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, চেষ্টা করছে থামানোর। তবে শৃঙ্খলা আনতে ব্যর্থ হচ্ছে।
আংশিকার মৃতদেহ বাড়ি থেকে বের করার পর পুলিশ বলছে, তার আত্মীয়রা বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে নিচতলায় ও বেসমেন্টে থাকা কাঠ বেশ বাজেভাবে প্রচণ্ডভাবে পুড়ে যায়। শিবানী, তার বাবা-মা এবং বাড়ির এক খালাকেও তারা আটকে রাখে।
শিবানী ও তার চাচি দ্বিতীয় তলার জানালা ভেঙ্গে পাশের বাড়িতে হামাগুড়ি দিয়ে আশ্রয় নেন। যেটি ছিল তার মামার বাড়ি। তবে তার বাবা-মা এত ভাগ্যবান ছিল না।
তিন ঘণ্টারও বেশি সময় আগুন জ্বলতে থাকার পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ভোর ৩টার দিকে বাড়িতে প্রবেশ করে। সেই সময় তারা বৃদ্ধ দম্পতির পোড়া মৃতদেহ দেখতে পান।
শিবানী চোখের জল মুছতে মুছতে বিবিসিকে বলেন, “আমার মায়ের মৃতদেহ সিঁড়িতে পাওয়া যায়। তাকে বস্তায় করে মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।” এক্ষেত্রে পুলিশে শিবানী আংশিকার পরিবারের ১২ জন সদস্য এবং ৬০-৭০ অজ্ঞাতনামা লোকের নামে অভিযোগ করেন।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, “আংশিকার বাবা, চাচা এবং তাদের ছেলেসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা কারাগারে রয়েছেন।”
এক্ষেত্রে আংশিকার বাবা পালটা অভিযোগ দায়ের করেছেন। তার অভিযোগ, “অংশু, তার বাবা-মা ও বোনরা যৌতুকের জন্য তার মেয়েকে হয়রানি করতেন। তাকে হত্যা করা হয়েছে।”
শিবানী তার পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। যদিও তিনি স্বীকার করেছেন যে, তারা বিয়েতে আংশিকার পরিবারের কাছ থেকে একটি গাড়ি সহ উপহার পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, “তারা তাদের মেয়েকে যা চেয়েছিল তা-ই দিয়েছে। আমরা কিছুই চাইনি।”
স্ত্রী মারা যাওয়ার পর রাত থেকে বাড়িতে ফেরেননি আংশু। শিবানী বলেন, “তিনি আত্মগোপনে আছেন। কারণ আশিকার আত্মীয়দের অধিকাংশই জেলের বাইরে রয়েছেন। তাই তিনি জীবন নিয়ে শঙ্কিত।”
ভারতে ১৯৬১ সাল থেকে যৌতুক দেওয়া ও নেওয়া উভয়ই বেআইনি। কিন্তু সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ৯০ ভাগ ভারতীয় বিবাহে এখনও যৌতুক দেওয়া-নেওয়া হয়।
দেশটিতে পুলিশ প্রতি বছর স্ত্রীদের হয়রানির হাজার হাজার অভিযোগ পায়। প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় যে, ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ভারতে যৌতুক ঠিকঠাক না আনার দায়ে ৩৫,৪৯৩ জন কনেকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু কথিত যৌতুকের মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে এই ধরনের ভয়ংকর প্রতিশোধের কথা শোনা যায় না।
শিবানী এখন তার মামার পরিবারের সাথে পাশের বাড়িতে থাকেন। তার সাথে তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সেদিন রাতের ট্র্যাজেডির অবশিষ্টাংশ সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। দেয়ালগুলো কালি দিয়ে কালো হয়ে গেছে। মেঝে পুরু ছাই দিয়ে ঢাকা। আসবাবপত্র সব পুড়ে ছাই হয়ে আছে।
শিবানী বলেন, “আমি ন্যায়বিচার চাই। আমার জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি বাড়ি ও পরিবার হারিয়েছি। আমি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু তদন্ত চাই এবং যারাই দোষী সাব্যস্ত হবে তাদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। কেন তারা বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে? এখন আমরা প্রমাণ কীভাবে পাবো?”
শিবানী পুলিশের ওপরও বেশ ক্ষুব্ধ। তিনি অভিযোগ করে বলেন, “আমাদের বাড়ির বাইরে অন্তত দুই ডজন পুলিশ ছিল। কিন্তু আমার মা-বাবাকে বাঁচাতে কেউ ঢুকেনি। তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল।”
পুলিশ আবার এই অভিযোগের তীব্র প্রতিবাদ করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিনিয়র পুলিশ অফিসার বিবিসিকে বলেন, “এটি একটি সংবেদনশীল ইস্যু ছিল। সকলে বেশ আবেগপ্রবণ ছিল। আমরা ঘটনাস্থল থেকে লাশটি সরিয়ে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার দিকে মনোযোগী দিয়েছিলাম। আমাদের লক্ষ্য ছিল ভিড় কমানো এবং পরিস্থিতি শান্ত করা।”
ঐ পুলিশ বলেন, “কেউ আশা করেনি যে বাড়িতে আগুন লাগানো হবে। এটি সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল। আমরা অবিলম্বে ফায়ার সার্ভিসকে ফোন করেছি। আমরা পাঁচজনকে উদ্ধার করতেও সাহায্য করেছি।”
ট্র্যাজেডিটি আংশিকার পরিবারকেও ক্ষতবিক্ষত করেছে। তাদের অবস্থা দেখতে বিবিসির পক্ষ থেকে তার বাবা-মায়ের বাড়িতে যাওয়া হয়। বছরখানেক আগেও আশিকা তার বিয়ের আগে পর্যন্ত থাকতেন। সেখানে বাড়ির মূল দরজায় বিশাল লোহার তালা দিয়ে তালা দেওয়া।
আশিকার বাড়ি থেকে মাত্র দুই কিমি দূরে তার মামার বাড়ি। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে তিনি ও তার ছেলেরা রয়েছেন। পরিবারটি এখন পর্যন্ত গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়নি।
দরজায় আওয়াজ করতেই জওহর লাল কেশরওয়ানি বের হয়ে আসে। যিনি আংশিকার অপ্রাপ্তবয়স্ক দাদা।
জওহর লাল বলেন, “আমি আপনাকে কী বলব? আমার পরিবারের সবাই, আমার ছেলে ও নাতিরা জেলে। তারা আনশিকাকে হত্যা করেছে এবং তিনি আত্মহত্যা করছে এমনটা বোঝাতে ফাঁসি দিয়েছে।”
আংশিকার বিয়ে নিয়ে জওহর লাল বলেন, “ওর বিয়েটি বেশ জমকালোভাবে হয়েছে। আমরা ৫ লাখ রুপি খরচ করেছি। আমরা তাকে পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু এবং একটি গাড়ি দিয়েছি। যার দাম ১৬ লাখ রুপি।”
জওহর লাল অনুশোচনা করে বলেন, “আংশিকা গত ফেব্রুয়ারিতে তাদের সাথে দেখা করেছিল। সে আমাদের বলেছিল যে, তাকে হয়রানি করা হচ্ছে। আমরা তাকে বলেছিলাম, তাকে সেখানে থাকতে ও মানিয়ে নিতে। আমরা তাকে বলেছিলাম, জিনিসগুলি আরও ভালো হবে।”
কেসারওয়ানিরা তাদের এলাকার বেশ স্বনামধন্য পরিবার। বিভিন্নভাবে তাদের নম্র ও বন্ধুত্বপূর্ণ হিসেবেই সকলেই জানতেন। এক্ষেত্রে এই ট্র্যাজেডির প্রতিবেশীদের হতবাক করেছে।
এক প্রতিবেশী বলেন, “তারা খুব ভালো মানুষ। আমরা কল্পনাও করতে পারি না যে, এমনটা কীভাবে ঘটতে পারে। তারা এমন লোক নয় যারা ঝগড়া-বিবাদে জড়িয়ে পড়ে।”
তিনি আরও বলেন, “কে আগুন জ্বালিয়েছে আমরা জানি না। তবে নিজের মেয়ের লাশ দেখলে যে কেউ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে।”
আশেপাশে থাকা এক নারী প্রতিবেশী বলেন, “আংশিকার আচরণ বেশ ভালো ছিল। তার মিষ্টি একজন মেয়ে। তারা খুবই সহজ-সরল। যে জঘন্য অপরাধের জন্য তাদের অভিযুক্ত করা হচ্ছে তারা সেটি করতে পারে না।”
তিনি আরও বলেন, “এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, তার বাবা-মা আগুনে মারা গেছে। কিন্তু যা আমাকে সত্যিই দুঃখিত করে তা হল আংশিকার কী হয়েছিল তা নিয়ে এখন কেউ কথা বলছে না। কীভাবে সে মারা গেল?”
