যশোর শহর-শহরতলীতে প্রতি সপ্তাহে ৩০ হাজার পচা ও নষ্ট ডিম সরবরাহ করে কাজল সিন্ডিকেট
এইচ আর তুহিন
প্রতি সপ্তাহে ময়লাখানায় ফেলে দেয়ার জন্য নিয়ে আসা প্রায় ৩০ হাজার পচা ও নষ্ট ডিম যশোর শহর ও শহরতলীর বিভিন্ন বেকারিতে সরবরাহ করা হচ্ছে। গর্হিত এ কাজ করছেন যশোরের মণিরামপুর উপজেলার ক্ষেদাপাড়া গ্রামের কাজল হোসেন। এ ডিম ওই এলাকার নাহার এগ্রো’র হ্যাচারি থেকে কাজল পিকআপে আনেন যশোর শহরতলীর ঝুমঝুমপুরে ময়লাখানায় ফেলার জন্য। কিন্তু তা না করে, কাজল সিন্ডিকেটের সদস্যরা ওই ময়লাখানার সামনে বিহারী কলোনীর প্রবেশ সড়কে একটি ঘর নিয়ে মধ্যরাতে কার্টন করছেন। এরপর ভোর রাতে এসব পচা ডিম বেকারিগুলোতে সরবরাহ করা হয়। নাহার এগ্রো’র হ্যাচারির শ্রমিকরা ওই ডিম ডাম্পিং (গুড়ো) করে দিতে গেলে শ্রমিকদের হুমকি-ধামকি দিয়ে তা করতে দেন না কাজল। আর এ পচা ডিম বাজারজাত করেন কাজল সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য যশোর সদরের নালিয়া গ্রামের আব্দুর রহিম ও রফিকুল ইসলাম।
ওই পচা ডিম বেকারিতে কেক তৈরিতে বেশি ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়াও পচা ও পুষ্টিহীন ডিম বিস্কুট, ডিম রোল, পুডিং, পেটিসসহ নানা বেকারি পণ্যে ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন খাবার তৈরি করতে ছোট-বড় বেকারিতে প্রতিদিন গড়ে ৫০০-১০০০ ডিম প্রয়োজন হয়।
চিকিৎসক, পুষ্টিবিদ ও প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা বলছেন, পচা ও বাচ্চা ফোটানোর জন্য হ্যাচারির হিটে রাখার ডিম যে কোনো মাধ্যমে খেলে ব্যাক্টেরিয়া ও ভাইরাসজনিত রোগে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। পেটের পীড়া হতে পারে। দীর্ঘ সময় হিটে থাকার কারণে ডিম পচে ও গুণাগুন নষ্ট হয়ে যায়।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, যশোরের মণিরামপুর উপজেলার ক্ষেদাপাড়া এলাকায় নাহার এগ্রো’র হ্যাচারি অবস্থিত। এ হ্যাচারিতে সপ্তাহে প্রায় দুই লাখ মুরগির বাচ্চা উৎপাদন হয়। ২১ দিন ডিমগুলো হিটে রাখা হয়। এতে প্রায় ১৫ ভাগ ডিম নষ্ট হয়। যার পরিমাণ ৩০ হাজার। এসব ডিম বেশিরভাগ পচে যায়। আর কোনো ডিম পানি শূন্য ও গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। কোম্পানি আইন অনুযায়ী এসব ডিম কারখানাতেই ডাম্পিং (গুড়ো) করে ময়লাখানায় ফেলে দিতে হবে। এই ডিম নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বপালন করেন খেদাপাড়া গ্রামের কাজল হোসেন। তিনি স্থানীয় প্রভাব বিস্তার করে হ্যাচারি শ্রমিকদের হুমকি-ধামকি দিয়ে ডিমগুলো ডাম্পিং না করিয়ে, তার নিজস্ব পিকআপে বের করে আনেন। যার পিকআপ নম্বর যশোর-ন-১১০৬৫৫। প্রথমে যশোর সদর উপজেলার নালিয়া গ্রামের একটি খালের পাশে কাজল সিন্ডিকেটের সদস্যরা বাজারজাতের লক্ষ্যে মধ্যরাতে কার্টন করতেন। এরপর স্থানীয়রা জানার পর বাধা দিলে তারা যশোর শহরতলী ঝুমঝুপুর এলাকায় ময়লাখানার সামনে বিহারী কলোনীতে একটি ঘর নিয়ে মধ্যরাতে কার্টন করছেন।
ওই নালিয়া গ্রামের ইউপি সদস্য নুর আলম টুটুল ঘটনার সত্যতা জানিয়ে দৈনিক কল্যাণকে বলেন, ‘এখন আর ওরা পচা ডিম এলাকায় আনে না। তবে পচা ডিম এখনও ওরা বেকারিতে বিক্রি করছে। মাঝেমধ্যে ওদের খালি পিকআপ এলাকায় দেখতে পাই।’
নাহার এগ্রো’র হ্যাচারির ইনচার্জ জিয়া-উস-শামস্ সেতু দৈনিক কল্যাণকে জানান, তাদের হ্যাচারিতে সপ্তাহে তিন লাখ ডিমের বাচ্চা উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। তবে বর্তমানে প্রায় দুই লাখ মুরগির বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছে। ডিমগুলো ২১ দিন হিটে রাখা হয়। বাচ্চা উৎপাদনে প্রায় ১৫ ভাগ ডিম নষ্ট হয়। বর্তমানে যার পরিমাণ
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কাজল আমাদের নষ্ট ডিম ময়লাখানায় ফেলার দায়িত্বে রয়েছেন। তবে সে বেকারিতে বিক্রি করে কি না, আমার জানা নেই। আর আমাদের শ্রমিকরা নষ্ট ডিম ডাম্পিং করে দেন বলে জানি। এর আগে কাজল ডাম্পিং করতে দেয় না বলে আমাকে শ্রমিকরা জানিয়েছিল। আমি কাজলকে আমি ডাম্পিং করে নিতে বলেছি। এটাই হওয়ার কথা। এ ব্যাপারে আরও মনিটরিং করবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কোম্পানির গাড়িতে মণিরামপুর পৌরসভার ময়লাখানায় ফেলতে চাই। কিন্তু এখনও অনুমতি না দেয়ায় কাজলের মাধ্যমে যশোর পৌরসভার ময়লাখানায় ফেলার ব্যবস্থা করেছি। মণিরামপুর হলে কোম্পানির গাড়িতেই ফেলতে পারবো।’
শহরতলী শেখহাটি, ঝুমঝুমপুর উপশহর এলকার বিভিন্ন বেকারির কারখানায় কর্মরত শ্রমিকরা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, তাদের কারখানায় পচা ও ফাটা ডিম ব্যবহার করা হয়। এসব বেকারির উৎপাদিত খাবার শহর ও শহরতলী ছোট-বড় বাজারগুলোতে সরবরাহ করা হচ্ছে।
অভিযুক্ত কাজল হোসেন ঘটনা অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি ময়লাখানায় যায় না। গাড়ি পাঠিয়ে দিই।’ এরপর তিনি মোবাইল ফোন কেটে দেন।
যশোর জেলা বেকারি মালিক সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, জেলায় সমিতিভূক্ত বেকারি মালিক আছেন ১৪০ টি। এরমধ্যে পৌরসভা ও শহরতলীতে বেকারির কারখানা রয়েছে ৩৮টি। এর বাইরেও কিছু অননুমোদিত কারখানা থাকতে পারে।
তিনি বলেন, পচা ডিম ব্যবহার না করার জন্য সদস্যদের বারবার তাগিদ দেয়া হয়। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন সভায় ব্যবস্থাগ্রহণে অনুরোধ করা হয়। জেলা প্রশাসন থেকে অভিযানও চালানো হয়।
তিনি আরও বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী খরচ কমাতে পচা ডিম ব্যবহার করে। এটা ঠিক না।
যশোর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা রাশেদুল হক জানান, দীর্ঘদিন উচ্চ তাপমাত্রায় ডিম থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ে যদি বাচ্চা না ফোটে তাহলে ডিম পানিশূন্য হয়ে পড়ে ও কুসুমের গুনগতমান ঠিক থাকে না। ফলে এটি খাবারের উপযোগী থাকে না।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইদুজ্জামান বলেন, বাচ্চা উৎপাদনের জন্য ডিম ২১ দিন নির্ধারিত তাপমাত্রায় থাকলে ডিমের এম্ব্রায়ো মারা যায়। পানি থাকে না। ফলে ডিম নষ্ট হয়ে যায়। খাবারের অযোগ্য হয়ে যায়।
যশোরের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. নাজমুস সাদিক রাসেল জানান, পচা ডিমে ব্যাক্টেরিয়া ও ভাইরাসজনিত জীবাণু থাকে। ফলে এ ডিম বা তৈরি কোনো খাবার খেলে জীবাণুঘটিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে যে কোনো প্রাণি।
এ ব্যাপারে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ওয়ালিদ বিন হাবিব জানান, বেকারিগুলোতে আমাদের তদারকি রয়েছে। তবে পচা ডিম সরবরাহকারীদের তথ্য আমাদের জানা নেই। জানতে পারলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোনো রকম ছাড় দেয়া হবে না।