আবদুল কাদের ও এসআই ফারদিন: যশোরের সরকারি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সিজারের মাধ্যমে সন্তান ভূমিষ্ট হওয়া প্রবণতা বেড়েছে। যশোর আড়াইশ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে অর্ধেক নরমাল ডেলিভারি হলেও বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে শতভাগ সিজারের মাধ্যমে শিশু ভূমিষ্ট হচ্ছে। গত এক দশকে বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নরমাল ডেলিভারি হয়েছে এমন নজির নেই। চিকিৎসকরা নরমাল ডেলিভারি করাতে নিরুৎসাহিত করে বলে রোগীরাও সেটি করাতে চায় না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নারীদের সিজার করাতে নিরুৎসাহিত করছে বহু আগে থেকে। বাংলাদেশ সরকারও অপ্রয়োজনীয় সিজারকে সমর্থন করছে না। কিন্তু তারপরও যশোরে সিজার করা থামছে না। যশোর আড়াইশ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নরমাল ডেলিভারি অর্ধেক হলেও শহরের সব বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে শতভাগ হচ্ছে সিজার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সি-সেকশনের (অস্ত্রোপচার) মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেয়া মায়েদের মধ্যে অপুষ্টির দ্বিগুণ বোঝা (ডাবল বার্ডেন অব ম্যালনিউট্রিশন) বেশি। স্বাভাবিক প্রসবে সন্তান জন্ম দেয়া মায়েদের তুলনায় এসব মায়ের অপুষ্টি দ্বিগুণেরও বেশি বলে সাম্প্রতিক এক গবেষণার তথ্যে পাওয়া গেছে।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত তিন বছরে যশোর আড়াইশ শয্যা হাসপাতালের লেবার ওয়ার্ডে শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েছে ৭ হাজার ৩শ ১৯ জন। তার মধ্যে নরমাল ডেলিভারি ৩ হাজার ৭শ ৮৯টি ও সিজার করা হয়েছে ৩ হাজার ৫শ ৩০টি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শহরের কুইন্স, আদ-দ্বীন, একতা, কিংস, দড়াটানা, নোভা, একতা হাসপাতালসহ শহরের সব বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে মাসে গড়ে একশটি সিজার করা হয়। সেখানে বছরে নরমালে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। বেসরকারিতে সবচেয়ে বেশি সিজার করে থাকেন গাইনি বিশেষজ্ঞ নার্গিস আক্তার মাসে ৩০-৪০টি, রেবেকা সুলতানা দীপা ২৫-৩০টি, নিকুঞ্জ বিহারী গোলদার ৩০-৩৫টি, রীনা ঘোষ ২০-২৫টি, ইলা মন্ডল ২০-২৫টি। এসব চিকিৎসকরা যেখানে চিকিৎসা করেন সেসব হাসপাতাল বা ক্লিনিকে খোঁজ নিয়ে গত এক দশকে কোন নরমাল ডেলিভারির তথ্য পাওয়া যায়নি।
শহরের বেজপাড়ার বাসিন্দা তিন সন্তানের জননী মমতাজ পারভিন জানান, তার তিনটি সন্তানই সিজার করেছেন দড়াটানা হাসপাতালে ডাক্তার রেবেকা সুলতানার কাছে। প্রথম সন্তান যখন দুই মাস পেটে তখন থেকে রেবেকা সুলতানাকে দেখাতে শুরু করি। সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার আগে তিনি বলেন, নরমাল ডেলিভারি করা যাবে না। শিশুর সমস্যা হতে পারে। তখন বাধ্য হয়ে সিজার করেছি। একই এলাকার সুলতানা বলেন, আমার ওজন বেশি থাকায় ডা. নিকুঞ্জ বিহারী গোলাদার সিজার করার পরামর্শ দেন।
আরএন রোডের বাসিন্দা মর্জিনা খাতুন বলেন, কুইন্স হাসপাতালের ডা. নার্গিস আক্তার আমাকে দেখে নরমাল ডেলিভারি হবে না বলে এক ধরণের ভয় দেখান। পরে আমার স্বামী সিজারে মত দেন। সব মিলিয়ে ওই চিকিৎসক ৪০ হাজার টাকা বিল করেন।
এদিকে সিজার করার ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপর বড় রকমের অর্থনৈতিক চাপ পড়ছে। এ কারণে অনেক দরিদ্র পরিবার তাদের আয়ের বড় অংশটি খরচ করে ফেলতে বাধ্য হন। এতে করে অনেকে ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েন।
বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে সিজার করতে গড়ে খরচ হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। এর বিপরীতে সরকারি হাসপাতালগুলোতে ৫-৭ হাজার টাকা খরচ হয় একটি সিজার করাতে।
২০২০ সালে শুধু যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ২ হাজার ৩শ ৩টি শিশু ভূমিষ্ঠ হয়। তারমধ্যে নরমাল ১ হাজার ২শ ৩১জন ও সিজার ১ হাজার ৭২ জন। ২০২১ সালে মোট শিশু ভূমিষ্ঠ হয় ২ হাজার ২শ ৮৮জন। তার মধ্যে নরমাল ১ হাজার ১শ ৭৩ জন ও সিজার ১ হাজার ১শ ১৫জন। চলতি বছরের ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত হাসপাতালে মোট শিশু ভূমিষ্ঠ হয় ২ হাজার ৭শ ২৮ জন। তার মধ্যে নরমাল ১ হাজার ৩শ ৮৫জন ও সিজার হয়েছে ১ হাজার ৩শ ৪৩ জনের।
অপ্রয়োজনীয় সিজার যারা সমর্থন করেন না এমন চিকিৎসকরা বলছেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানে সিজারের সংখ্যা সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ পর্যন্ত স্বাভাবিক বলে মনে করা হয়। কিন্তু এই সংখ্যা ৩৫ শতাংশ পেরিয়ে গেছে। গর্ভবতী মা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চান না। ফলে সবাই সহজেই সিজারের দিকে ঝুঁঁকে পড়ছেন।
যশোরের সিভিল সার্জন ডা. বিপ্লব কান্তি বিশ^াস বলেন, যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ৮ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ছাড়াও আশেপাশের চার জেলা থেকে কিটিক্যাল প্রসূতিদেরকে রেফার করা হয়। তাদেরকে শেষ মুহূর্তে সিজার করতে হয়। অনেকের আবার প্রথম শিশুটি সিজার করা থাকলে দ্বিতীয় শিশুটিকেও সিজার করা লাগে। একটি প্রসূতি মায়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেস হিস্ট্রি রেকর্ড থাকলে চিকিৎসক অপ্রয়োজনীয় সিজার করার আগে একবার হলেও ভাববেন। কেন সিজারটি করা হয়েছে? এটা এড়ানোর জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এটা করার আগে অন্য কোনো ব্যবস্থা করা হয়েছিল কিনা এবং একজন প্রসূতিবিদ মাসে কয়টা সিজার করেছেন-এই বিষয়গুলো দেখা হলে সিজারের পরিমাণ কমে যাবে।
এব্যাপারে ডাক্তার নার্গিস আক্তারর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ব্যস্তা আছি পরে কথা বলব। ডা. রেবেকা সুলতানা বলেন, আমি সিজারে ব্যস্ত আছি; পরে ফোন করেন।
যশোর সদরের ফরিদপুর গ্রামের মেহেদী হাসান উজ্জলের স্ত্রী শারমিন আকতার বলেন, ইনফেকশনের ড্রেসিংয়ের কষ্ট সহ্য করা কঠিন। ইনফেকশন হলে চলাফেরা করা কঠিন আবার নবজাতকের পরিচর্যা করা যায় না।
সূত্রের দাবি, চিকিৎসকরা ঝামেলা এড়াতে সিজার করে থাকেন। রোগীর পরবর্তীতে শারীরিক অবস্থার কথা তারা চিন্তা করেন না। সিজারিয়ান রোগীর সেলাই থেকে শুরু করে বাকি কাজ করেন ওটি বয় ও ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা। যার ফলে ইনফেকশনের হার দিন দিন বেড়েই চলছে সরকারি এই হাসপাতালটিতে।
যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আখতারুজ্জামান বলেন, আমাদের চিকিৎসকরা অপ্রয়োজনীয় সিজার যাতে না করে সেজন্য নির্দেশনা দেয়া আছে। চিকিৎসকরা চেষ্টা করেন যাতে রোগীর নরমল ডেলিভারি হয়। এজন্য অন্তত অর্ধেক নরমাল ডেলিভারি করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালের চিন্তা বাণিজ্যিক। এজন্য রোগী অর্ধেক পঙ্গু হয়ে যায়।