“প্রতি বছর শীত এলেই কিছু মানুষ নানা সংগঠনের নামে শীতার্তদের নাম ভাঙিয়ে চাঁদা তুলে থাকেন। সেসব অর্থ থেকে যৎসামান্য শীতার্তদের জন্য ব্যয় করা হয়। সেটাও ঘটে বড় বড় শহরের আশে-পাশে। ফলে শহরের একজন দরিদ্র বা বস্তিবাসী একাই অনেকগুলো ত্রাণের কম্বল বা অর্থ পেয়ে যান”
প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম: এবারের শীতে নেই তেমন কোনো মজা, কোনো আমেজ! এমনি করে করে কি শীতকালটা ফুরিয়ে যাবে? অন্যদিকে ওমিক্রনের ও ডেলমিক্রনের নতুন ভয়। তাই পরিবার নিয়ে কোথাও বের হতে পারবেন না বলে নিচের ভাবিসাহেব মুখটা গোমড়া করে সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন। শুনে মনে হলো- এবারের শীতে শহরের বাইরে দূর গাঁও-গেরামের নির্ভৃত কোনো ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা জায়গায় ভ্রমণে যেতে না পেরে তার জীবনটাই বৃথা হয়ে গেল। হবেই না বা কেন? জন্ম তো সেই কাদা মাখা, স্নেহ-ঢাকা পল্লী মায়ের আদরের আঁচলে। এটা একজন ভাবির মনের আক্ষেপের কথা হলেও আমার মনে হয় হাপিত্যেশ করা হাজার হাজার ভাবিদের মনের কথা তিনি বলে দিয়েছেন।
যা হোক, গ্রাম সবসময় মানুষকে টানে। যদিও গ্রামগুলো ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। কোনো পরিবারের একজন উচ্চশিক্ষিত হলেই হলো। তিনি আর গ্রামে থাকার অনুপ্রেরণা খুঁজে পাবেন না। উচ্চশিক্ষিত হলেই শহরে গিয়ে চাকরি করতে হবে। তার জন্য গ্রামের চিরচেনা শান্তিময় পরিবেশ যেন বিষিয়ে ওঠে। কারণ গ্রামে নেই কোনো অফিস, নেই কোনো হাসপাতাল অথবা বাসস্থানের অবকাঠামো। শুধু তাই নয়-জেলা শহরে যে হাসপাতাল বা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠার কথা সেটাও জায়গা নিয়েছে রাজধানী ঢাকার কোনো আবাসিক এলাকার গলিতে বা ঘিঞ্জি কাঁচা বাজারের ছাদে! তাইতো মানুষ সহজাত তাগিদেই একটু সবুজের দিকে ফিরে যেতে চায়। হোক না তা স্বল্পসময়ের জন্য!
গ্রামীণ শীতকাল অনেক কিছুর সাথে উপহার দেয় টাটকা শাক-সবজি ও মিষ্টি খেজুরের রস। জীবিকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে বাধ্য হয়ে শহরে বসতি গেড়ে নেওয়া অনেকে গ্রামের রসের পিঠা, ভাপা পিঠার কথা ভুলতে পারেন না। তাইতো সেটা যখন শহরের রাজপথের পাশে ময়লা ধুলোবালিতে কোনো ফেরিওয়ালাকে বানাতে দেখেন-তক্ষুণি তার মনে জেগে ওঠে গ্রামের কথা।
পোড়ের ছাইচাপা আগুনে মিষ্টি আলু পোড়ানো, ভুট্টা, মটরশুটি বা নোয়া ডাং (এক ধরনের লম্বা লাল ধান) ধানের খৈ ফুটিয়ে গরম গরম খাওয়া- ইত্যাদি তো অনেকের মধুর সুখস্মৃতি বৈ কিছু নয়! আর এগুলো করতে গিয়ে অনেকে আতœভোলা হয়ে যায়। বিশেষতঃ ছোট শিশুরা। তারা হাত-পা পুড়িয়ে ফেলে। সাধারণতঃ শীতকালে বেশি বয়স্ক মানুষেরা বেশী ঠান্ডা অনুভুব করেন। তাদের গায়ে গরম কাপড়ের সাথে কাঁথা-কম্বল জড়িয়ে নিতে দেখা যায়। এছাড়া সেগুলো পরেই তাদের অনেকেই দীর্ঘ সময় পোড়ের আগুনের পাশে বসে থাকতে পছন্দ করেন। শহরের মানুষ অথবা নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানেন না ‘পোড়’ অর্থ কি। ‘পোড়’ বলতে ধান-গমের নাড়া,খড়, ভুট্টা ও খেসারি কলাইয়ের শুকনো ডান্ডা, গাছের ঝড়াপাতা, গোবরের ঘষি, শুকনো ঘাস, ইত্যাদি দিয়ে জ্বালানো আগুন বোঝানো হয়। এলাকাভেদে এসব উপকরণের ভিন্নতা লক্ষণীয়। অনেকগুলো উপকরণ একসঙ্গে জড়ো করে বাড়ির ভেতর বা বাহির আঙিনায় ‘পোড়’ বা আগুনের ঢিবি বানানো হয়।
কৃষাণ-কৃষাণী পরিবারের সবাই সকালে ‘পোড়ে’র চতুর্দিকে গোল হয়ে বসে আগুন পোহান। গ্রামে বেশিরভাগ বাড়িতে এখন টিনের চালা দেয়া ঘর। এ ঘরগুলোতে রাতে টিন ঠান্ডা হতে হতে শেষরাতে আরো বেশি ঠান্ডা অনুভূত হয়।
বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম ও লালমণিরহাট জেলায় শীতে আগুন পোহাতে গিয়ে ৬ জনসহ দেশের অন্যান্য স্থানে বাচ্চা ও বৃদ্ধাসহ ২২ জন দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং দগ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ৪০০ জন বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয়েছিল (ঢাকা ট্রিবিউন ২৮.০১.২০১৮)। এ বছর উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় শীতের সাথে কনকনে বাতাস এবং শিলাবৃষ্টি হবার কথা শোনা যাচ্ছে। ঝড়ে ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, নীলফামারী প্রভৃতি জেলায় ২৫ হাজার টিনের বাড়ি উড়ে গিয়েছে (সময়নিউজ ১৬.০১.২০২২)। এছাড়া এ বছর শীতের শুরুতেই আগুন পোহানোর কারণে দেশের কয়েক জায়গায় দুর্ঘটনার খবর জানা গেছে। শীত নিবারণে আগুন পোহাতে গিয়ে গত তিনদিনে দেশের উত্তরাঞ্চলে দু’জন মারা গেছে এবং হাসপাতালে দগ্ধ রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। তবে এটা যেন আর না ঘটে সে জন্য সবাইকে সতর্কতার সাথে পোড়ের পাশে বসতে হবে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা যাতে পোড়ের আগুন পোহানো থেকে বিরত থাকেন সে জন্য তাদেরকে পর্যাপ্ত গরম কাপড় ও গরম পানীয় ও খাবার সরবরাহ করতে হবে। শৈত্য প্রবাহের আগাম সংবাদ গ্রামে-গঞ্জে মাইকিং করে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রতি বছর শীত এলেই কিছু মানুষ নানা সংগঠনের নামে শীতার্তদের নাম ভাঙিয়ে চাঁদা তুলে থাকেন। সেসব অর্থ থেকে যৎসামান্য শীতার্তদের জন্য ব্যয় করা হয়। সেটাও ঘটে বড় বড় শহরের আশে-পাশে। ফলে শহরের একজন দরিদ্র বা বস্তিবাসী একাই অনেকগুলো ত্রাণের কম্বল বা অর্থ পেয়ে যান।
আমাদের দেশে ধনী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। পাশাপাশি হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এক হিসেব মতে-দেশে এখনও তিন কোটি মানুষ নি¤œআয়, নদীভাঙা ও কর্মহারা হয়ে দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে। এদের বেশিরভাগ গ্রামীণ ভূমিহীন হতদরিদ্র (হার্ডকোর পুওর) অথবা চরম দরিদ্র (আল্ট্রা-পুওর) শ্রেণির। যাদের মৌলিক মানবিক চাহিদা অপূরিত থাকে ও যারা মৌল-মানবিক সেবাদান প্রক্রিয়ায় নিজ অংশগ্রহণ অক্ষমতা বিবেচনায় বাদ পরে যায়। যেমন-খাদ্য ও চিকিৎসা সেবা কিনতে না পারা। উন্নত দেশগুলোতে শহুরে মানুষেরা প্রতিবছর নিজেদের পুরনো জিনিসপত্র, কাপড় ইত্যাদি স্বল্পমূল্যের খোলা বাজারে (ফ্লি-মার্কেট),পার্কে বা গ্যারাজ সেলে রেখে দেয়। স্বল্প আয়ের মানুষেরা সেগুলো পানির দামে অথবা বিনামূল্যে সংগ্রহ করে।
আমাদের ধনী পরিবারগুলোর আলমারীতে যুগ যুগ ধরে অব্যবহৃত পুরনো দ্রব্য, কাপড় ইত্যাদি থাকলেও কখনও গরীবের জন্য হৃদয় গলে না। অথচ, দান-খয়রাত মুসলিমদের ধর্মীয় অনুষঙ্গ। তাই সমাজের সামর্থ্যবান সবাইকে আহবান করব নিজেদের অপ্রয়োজনীয় অব্যবহৃত কাপড়-সামগ্রীগুলো মানব কল্যাণে পুনঃব্যবহারের (রি-সাইকেল) জন্য বিতরণের ব্যবস্থা করুন।
এ বছর হতদরিদ্রদের শীত নিবারণে বিভিন্ন সংগঠন এমনকি সেনাবাহিনী কম্বল বিতরণ করছে। এ কল্যাণমূলক কাজে মানুষকে আরো বেশি এগিয়ে আসা দরকার। কম্বলগুলো প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের অতি দরিদ্র মানুষের হাতে পৌঁছানোর জন্য আগেভাগে প্রকৃত খানা-আয় জরিপ করে বিতরণ করা উচিত। এ জন্য স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্কাউট বা রোভার-রেঞ্জার, বিএনসিসি ইউনিটগুলোকে কাজে লাগিয়ে তাদের নিকট থেকে প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করতে উৎসাহিত করলে ভাল হবে। তারাও নিজ দায়িত্বে গ্রামের অশীতিপর বয়স্ক ও প্রকৃত গরীব দুঃখীদের নিকট সেগুলো পৌঁছানোর নৈতিক দায়িত্ব পালন করতে পারে। এভাবে আমরা সবাই শীতের স্বাদ পেতে পারি এবং শীতের ঠান্ডা নিবারণে ‘পোড়ের আগুনের’ সমূহ সাজা ও বিপদ থেকে বাঁচার জন্য গ্রামের গরীব দুঃখীদের সহায়তা করে অনেক মূল্যবান জীবন রক্ষা করতে পারি।
লেখক: অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।