কাজী বর্ণ উত্তম
১৯৯৫ সালে একটি সার্ভেতে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষের দেশ হিসাবে প্রথম হয়েছিলো যে দেশটি-তার নাম বাংলাদেশ। দারিদ্র পীড়িত একটি মানুষের দেশ হওয়ার পরও প্রগাঢ় পারিবারিক বন্ধনের কারণে সুখের তালিকায় প্রথম হয়েছিল বাংলাদেশ। আসলে একটি গাছ যত বড়ই হোক না কেন শেকড়ের সাথে সংযোগ না থাকলে সে বাড়তে পারবে না। মানুষের ক্ষেত্রেও তদ্রুপ। জীবনের শুরু হয়েছে পরিবার থেকে, আপনি বেড়ে উঠেছেন পরিবারে, বিপদে-আপদে সংকটে মোকাবেলায় পরিবারের ভূমিকা অনন্য।
আজকের গণতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির পেছনে ছুটতে ছুটতে ছেলেমেয়েরা কেমন জানি আগের মত মুরব্বিদের পরোয়া করছে না। সামান্য ব্যাপারেই পরিবারিক বন্ধন ভাঙ্গন ও বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ন্যূনতম মনুষ্যত্ব ও মানবতা বোধের পরিচয় দিতেও ব্যর্থ হচ্ছে। বর্তমান সমাজে পরিবারের দায়িত্ববোধ কমে যাচ্ছে এবং এর গুরুত্বকে খাটো করে দেখা হচ্ছে। ফলে পরিবারের সদস্যদের আকর্ষণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে বাবা-মা-ভাই-বোন কেউই কারো প্রতি মায়া-মমতা, ভালোবাসা যথাযথ দায়িত্ববোধ অনুভব করছে না। পরিবার থেকে পাচ্ছে না মানুষ হওয়ার প্রকৃত শিক্ষা। কিছুদিন আগে পর্যন্ত বয়োবৃদ্ধদের হাতেই পরিবারের নানাবিধি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সমস্ত ক্ষমতা ছিল। পরিবারের অন্যান্যরা তাদের কাছেই যেকোন বিষয়ে পরামর্শ নেয়ার জন্য ছুটে যেত। কিন্তু বর্তমানে পরিবারের এই চিত্র একদম বদলে যাচ্ছে। এখন পরিবারে কেউ যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বয়োজ্যেষ্ঠদের ওপর ভরসা রাখতে পারেন না। নতুন প্রজন্মের সদস্যদের ক্যারিয়ার গড়তে, চাকরি-বাকরির জন্য দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে কিংবা বাচ্চাদের শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রেও তারা পূর্বের মত ভূমিকা রাখতে পারেন না। ফলে পরিবারে তাদের উপযোগিতা হ্রাস পাওয়ায় সংসারের কর্তৃত্বে পরিবর্তন এসেছে। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে উন্নত দেশের অনুকরণ করার কারণে ভুলে যাচ্ছি আমাদের শেকড়কে, আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্যকে। এই কঠিন জীবনপ্রবাহে পরিবারকে টিকিয়ে রাখতে তাদের ভূমিকা আমরা বেমালুম ভুলে যাচ্ছি, অগ্রাহ্য করছি তাদের অস্তিত্বকে। সময়ের আবর্তে পরিবারের সকলের সাথে মিলেমিশে থাকাটা এক সময় উপন্যাসে বা সিনেমার দৃশ্যে দেখতে হবে হয়তো।
বাংলাদেশের সমাজ জীবনে স্বার্থপরতা ও নিম্নমানের আচরণ বিকশিত হচ্ছে। ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে মানবিক মূল্যবোধের বদলে নৃশংসতা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। মানুষের কল্যাণ চিন্তার বদলে কতিপয় অনৈতিক ব্যক্তির উত্থান সমাজকে প্রভাবিত করছে, সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে ঘুষ, দুর্নীতি, ভেজাল, মূল্যবৃদ্ধি, খুন, ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতনের মতো পাশবিকতা।
পরিবারে, প্রতিবেশির এবং সমাজের দুস্থ, পশ্চাৎপদ অবহেলিত মানুষের মর্ম যাতনাকেও হৃদয়ঙ্গম করা সকলের দায়িত্ব। উৎসব ও আনন্দ তখনই সার্থক ও সফল হয়, যখন তা সবার মুখে হাসি আনতে পারে। হাদিস শরীফে এসেছে- ‘যখন ঈদের দিন তথা ঈদুল ফিতরের দিন আসে তখন আল্লাহ বান্দাদের বিষয়ে ফেরেশতাদের সঙ্গে গর্ব করেন। বলেন, হে আমার ফেরেশতারা! যে শ্রমিক তার কর্ম পূর্ণ করেছে, তার বিনিময় কী? তারা বলবে, তাদের বিনিময় হলো তাদের পারিশ্রমিক পরিপূর্ণরূপে প্রদান করা’।
রমজানের রোজার শিক্ষায় আমরা যেমন ত্যাগ, কৃচ্ছ্বতা, আত্মসংযমের দীক্ষা লাভ করি, ঈদেও আমরা পাই মানবিক ও সামাজিক দায়িত্বশীলতার প্রেরণা। সকলের সঙ্গে সকলের শুভেচ্ছা, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য বিনিময়ের যে ধারা ঈদের উৎসবে উপস্থিত হয়, তাতে ব্যক্তিগত আনন্দ সামাজিক আনন্দের বিশালতায় রূপান্তরিত হয়।
অভাবী, দরিদ্র ও দরিদ্র পীড়িতদের মধ্যে স্বচ্ছল এবং বিত্তশালীদের নির্দিষ্ট হারে অর্থ প্রদানের কর্তব্য বিধানের মাধ্যমে ঈদুল ফিতর- পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, গরীব সবার মধ্যেই আনন্দের সেতুবন্ধন সৃষ্টি করেছে। সামাজিক অঙ্গনে বন্ধন সৃষ্টিকারী ঈদের ইতিবাচক বিষয়টি সঞ্চারিত হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জীবনে আত্মীয়-পরিজনের মধ্যে মেলামেশার মাধ্যমে সৃষ্ট এই সামাজিক গতিশীলতার মূল্য অপরিসীম। আমরা আমাদের শেকড়ের স্পর্শ অনুভব করি উৎসবের মাধ্যমে।
লেখক,
সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক,
যশোর জেলা আওয়ামী লীগ।