আনোয়ার হোসেন, মণিরামপুর
পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া ২ লাখ টাকা ব্যাংক থেকে তুলে ঘরে রেখে ধান ক্ষেতের পরিচর্যা করতে স্ত্রীকে নিয়ে মাঠে গিয়েছিলেন মোসলেম হোসেন। ক্ষেত থেকে ধোয়া দেখতে পেয়ে দৌঁড়ে আসেন ঘরের সামনে। ততক্ষণে ঘরের ভিতরে আগুন দাউদাউ করে জ্বলছিল। আগুনের ফুলকিতে সামনে এগুতে পারেননি মোসলেম। চোখের সামনে সবকিছু পুড়ে ছাই হয়েছে ভূমিহীন এ বৃদ্ধের।
জমি বর্গা রাখার জন্য সমিতি থেকে তোলা ৪০ হাজার টাকাসহ ভ্যান চালিয়ে জমানো আরো ২০ হাজার টাকা ঘরে বাক্সে রেখেছিলেন আলমগীর হোসেন। পাশের ঘরে লাগা আগুন ধেয়ে এসে চোখের পলকে টাকাসহ ঘরের আসবাবপত্র, কাপড় চোপড় ছাই করে দিয়েছে। একইভাবে আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে সোহেল রানার গরু বিক্রির ১ লাখ ২২ হাজার টাকা।
এভাবে চোখের সামনে পুড়ে সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়েছেন যশোরের মনিরামপুরের গোবিন্দপুর আশ্রয়ণ পল্লির ১০টি ভূমিহীন পরিবার। পুড়েছে সরকারিভাবে পাওয়া জমির দলিলপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র।
গত সোমবার বিকেল সাড়ে ৪ টার দিকে আশ্রয়ণ পল্লিতে হঠাৎ লাগা আগুন ২০ মিনিটে ১১ নম্বর ঘর থেকে ২০ নম্বর পর্যন্ত ঘরের সব কিছু পুড়ে গেছে। খবর পেয়ে মণিরামপুর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ৩ ঘণ্টা চেষ্টা করে রাত ৮ টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। রাতে যখন আগুন নেভে ততক্ষণে বেঁচে থাকার অবলম্বন হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে ১০টি পরিবার। এরপর থেকে মানবেতর সময় কাটাচ্ছে পরিবারগুলো। থাকার ঘর হারিয়ে তারা এখন আশ্রয় নিয়েছেন রান্নাঘর, গোয়ালঘর বা খোলা আকাশের নিচে। এখন সম্বল বলতে পরিবারগুলোর রয়েছে শুধুই ছাই।
সেই ছাই হওয়া অবলম্বনের দিকে তাকিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিহীন লোকগুলো। বুধবার দুপুরে সরেজমিন ক্ষতিগ্রস্ত আশ্রয়ণ পল্লি ঘুরে এমন চিত্র চোখে পড়েছে।
এদিকে খবর পেয়ে সোমবার রাতেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাকির হোসেন, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নাজমা খানমসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। উপজেলা প্রশাসন উপস্থিত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ২০ হাজার টাকা সহায়তা দিয়েছে। এরপর মঙ্গলবার থানা বিএনপি ও উপজেলা যুবলীগের পক্ষ থেকে পরিবারগুলোকে ত্রাণ সামগ্রী দেওয়া হয়।
এদিকে বুধবার দুপুরে পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনে দ্রুত সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
২০০৮ সালে উপজেলার খানপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে খাস জমিতে টিনের বেড়া ও চালার ৪০টি ঘর নির্মাণ করে সরকার। এরপর ইউনিয়নের ৪০টি ভূমিহীন পরিবার সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। এ পল্লির অধিকাংশ পুরুষ দিনমজুর। কেউবা ভ্যানচালক। আর নারী সদস্যরা মাঠ বা কারখানার শ্রমিক।
আশ্রয়ণ পল্লির আলমগীর হোসেন, রফিকুল ইসলাম, রনি হাসান, কাসেম খন্দকার, সোহেল রানা, ফিরোজা বেগম, মোসলেম হোসেন, রিক্তা খাতুন, মাসুদ রানা ও তহমিনা বেগম সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন।
ক্ষতিগ্রস্ত মোসলেম হোসেন বলেন, অনেক টাকা ঋণে আছি। ঢাকায় বাবার এক টুকরো সম্বল বেচে ভাগেরভাগ দু’লাখ টাকা পাইছি। সে টাকা তুলে এনে ঘরে রাখিছি। ভাবিছি এ দিয়ে ধারদেনা শোধ করব। টাকা তুলে ঘরে ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যে আগুন লেগে আমার সব শেষ হয়ে গেছে।
ফিরোজা বেগম বলেন, স্বামী থেকে পৃথক হওয়ার পর ১৫ বছর আগে একমাত্র মেয়েকে নিয়ে আশ্রয়ণের ঘরে উঠি। মাঠে কামলা দিয়ে তিলে তিলে ঘর গুছিয়েছি। আগুন লেগে সব শেষে হয়ে গেছে। পরনের কাপড়টা ছাড়া বিছিয়ে শোয়ারমত একটা কাগজও নেই। এখন রান্না ঘরে থাকছি। পোড়া ঘরের দিকে তাকালে বুক হাহাকার করে ওঠে।
প্রত্যক্ষদর্শী মেহেদী হাসান সোহাগ বলেন, আশ্রয়ণের ১৬ বা ১৭ নম্বর ঘর থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। একে একে পাশাপাশি ৮টি ঘরে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় ঘরের বাসিন্দারা বাইরে যে যার মত কাজে ছিলেন। আগুন দেখে সবাই ছুটে এসে নেভানোর চেষ্টা করে। ফায়ার সার্ভিসে খবর দিলে তারা ২০ মিনিটের মাথায় চলে আসে। এরপর ৩ ঘণ্টা চেষ্টা করে তারা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তিনি বলেন, এ দৃশ্য দেখার না। মুহূর্তে সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
মণিরামপুর ফায়ার স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রণব বিশ্বাস বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে বৈদ্যুতিক শক সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমান আনুমানিক সাড়ে ৫ লাখ।
মণিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর তালিকা করা হয়েছে। ঘর মেরামতের জন্য তাদের টিন ও নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হবে।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে এসএম ইয়াকুব আলী : মণিরামপুরের গোবিন্দপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পের আগুনে পুড়ে যাওয়া ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন এসএম ইয়াকুব আলী। বুধবার সকালে ক্ষতিগ্রস্থ ১০ পরিবারের মাঝে খাদ্যসামগ্রী ও নগদ অর্থ প্রদান করেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক উপ-কমিটির নির্বাহী সদস্য এসএম ইয়াকুব আলী। ক্ষতিগ্রস্থ প্রতি পরিবারকে চাল, ডাল, তেল, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, গুড়া দুধসহ নগদ টাকা প্রদান করা হয়। এসময় উপস্থিত ছিলেন খানপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ মিলন, শ্যামকুড় ইউনিয়ন আওয়ালী গীগের আহ্বায়ক আহাদুল করিম, যুগ্ম আহ্বায়ক ফজলুর রহমান, ইউপি সদস্য রফিকুল ইসরাল বুলুসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।
