মিহির কুমার রায়
কৃষকের জন্য ১০ টাকায় বিশেষ ব্যাংক হিসাব বা অ্যাকাউন্ট খোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল ২০১০ সালে। বিশেষ এই ব্যাংক হিসাবের ৮০ শতাংশই খোলা হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকে। এখন পর্যন্ত দেশে এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি। যদিও এসব হিসাবে কৃষকের অর্থ জমেছে খুবই সামান্য পরিমাণে। এক যুগে ব্যাংক হিসাবগুলোয় গড় সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫৭৯ টাকা।
এসব ব্যাংক হিসাবের বড় অংশেই কোনো লেনদেন নেই। তবে হিসাবগুলোর মধ্যে ২৮ লাখ ৩৭ হাজার ৭৯৭টি সরকারি ভর্তুকি প্রদানের কাজে ব্যবহার হচ্ছে। ৬০ হাজার ব্যাংক হিসাবে ২০০ ও ৫০০ কোটি টাকার বিশেষ পুনঃঅর্থায়ন তহবিল থেকে ঋণ দিয়ে সচল রাখা হয়েছে। রেমিট্যান্স গ্রহণের মাধ্যমেও সক্রিয় আছে অল্প কিছু ব্যাংক হিসাব। এর বাইরে থাকা ব্যাংক হিসাবগুলো প্রায় অকার্যকর বলে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জুন শেষে দেশের কৃষকের ১০ টাকার বিশেষ ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৮ লাখ ২০ হাজার ৬৯৯টি। এসব ব্যাংক হিসাবে সঞ্চয় আছে মাত্র ৫৬৯ কোটি টাকা।
প্রতিবছরই কৃষি ও কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নে ঋণ নীতিমালা ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক কৃষি ও পল্লি ঋণ বিতরণের লক্ষ্য ঠিক করেছে ৩০ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। যা গত অর্থ বছরের চেয়ে ৮.৮৮ শতাংশ বেশি। এবার কৃষি ও পল্লি ঋণের চাহিদা বিবেচনায় চলতি অর্থ বছরে মোট লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো ১১ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা এবং বেসরকারি ও বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক ১৯ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। বিগত ২০২১-২২ অর্থ বছরে ব্যাংকগুলো মোট ২৮ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লি ঋণ বিতরণ করেছে, যা অর্থ বছরের মোট লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, গত অর্থবছরে কৃষি ও পল্লি ঋণ পেয়েছেন ৩৩ লাখ ৪ হাজার ৮১১ জন কৃষক। এর মধ্যে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব নেটওয়ার্ক ও মাইক্রো ফাইন্যান্স ইনস্টিটিউশনের (এমএফআই) মাধ্যমে ১৭ লাখ ৯৭ হাজার ৫২ জন নারী কৃষি ও পল্লি ঋণ পেয়েছেন ১০ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া গত অর্থবছরে ২৪ লাখ ৯৯ হাজার ৯৪৫ জন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ২০ হাজার ১৮২ কোটি টাকা এবং চর, হাওর প্রভৃতি অনগ্রসর এলাকার ৪ হাজার ৭৩ জন কৃষক প্রায় ১৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ঋণ পেয়েছেন।
কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় কৃষিতে বড় অংকের ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। এসব নীতির সুফল কৃষকদের আর্থিক দীনতা কাটাতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে ভূমিকা রাখলেও কৃষক বরাবরই বঞ্চিত ও উপেক্ষিত থেকেছেন। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যেসব নীতি নেয়া হয়, তার সুফল প্রান্তিক কৃষকদের কাছে পৌঁছায় না। সুশাসনের অভাব, দুর্নীতি ও সরবরাহ ব্যবস্থার ঘাটতির কারণে প্রকৃত কৃষক বঞ্চিতই থাকছেন।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কালুহাটি গ্রামের কৃষক দুদুল আবিষ্কার করেছেন দুদুলতা নামে স্থানীয় ধানের জাত। ধান, পোটল, কলা ও বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি মিলিয়ে মোট ১০ বিঘা জমিতে চাষ করেন তিনি। কৃষি ব্যাংক, জনতা ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকে হিসাবও খুলেছেন। তবে কোনোটিই তিনি ব্যবহার করেন না। হিসাবগুলোয় কোনো টাকাও নেই। এ কৃষক বলেন, ‘ব্যাংক হিসাব দিয়ে কী করব? কোনো কাজে তো আসছে না। সংসারের ব্যয় নির্বাহেই জীবন শেষ। ব্যাংক হিসাবে টাকা থাকবে কোত্থেকে। উৎপাদিত শস্য বিক্রি করে যা পাই তা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের জীবিকা নির্বাহের পর বাকি কিছু থাকে না। অনেক সময় ধার-কর্জ করেও চলতে হয়।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের জুন শেষে কৃষি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণ স্থিতি ছিল ৪৯ হাজার ৮০২ কোটি টাকা। শুধু গত অর্থবছরে ব্যাংকগুলো ২৮ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকার কৃষি ঋণ বিতরণ করেছে। একই সময়ে কৃষকের কাছ থেকে ২৭ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা আদায় করেছে ব্যাংকগুলো। তবে কৃষকের মধ্যে বিতরণকৃত এ ঋণের ৭৫ শতাংশই গিয়েছে এনজিওগুলোর মাধ্যমে। ব্যাংকগুলো এনজিওকে ঋণ দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছে। ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ সুদে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যদিও এনজিওগুলো কৃষকের কাছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ সুদেও ঋণ বিতরণ করছে বলে জানা গেছে।
সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, ব্যাংক শাখার কর্মকর্তারা কৃষকের ১০ টাকা মূল্যের অ্যাকাউন্টগুলোকে ভালোভাবে দেখেন না। এসব হিসাবকে তারা বাড়তি বোঝা বলে মনে করেন। তা ছাড়া দারিদ্র্যপীড়িত কৃষকদের তেমন কোনো সক্ষমতা নেই যে তারা তাদের ব্যাংক হিসাবে নিয়মিত লেনদেন করবেন। সারা বছরে যেটুকু সরকারি সহায়তা আসে তাও যৎসামান্য। এখন থেকে তিন দশক আগেও মনে করা হতো, ক্ষুদ্র কৃষকরাই ছিলেন দক্ষ বিশেষত খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে। বর্তমানে এই ধারণাটির আর কোনো বাস্তবতা নেই কেবল বাজার অর্থনীতির কারণে।
এখন যান্ত্রিকীকরণের ফলে খামারের আয়তন বৃদ্ধি জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে, যা ছোট আকারের খামারিদের জন্য একটি দুঃসংবাদ। কৃষি বাণিজ্য উদারীকরণ এবং খামারের আয়তন বৃদ্ধি একটি জরুরি বিষয়. যা সময়ের দাবি। বিশেষ করে খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টিকে বিবেচনায় রেখে। সরকার এ ব্যাপারে সব ধরনের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান বছরের বাজেটে ১৬ হাজার কোটি টাকা কৃষি খাতে ভর্তুকি এবং আরও ১৫ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে কৃষক ও কৃষির উন্নয়নের জন্য। কৃষি হলো বাংলাদেশের কৃষ্টি এবং কৃষক হলো বাংলাদেশের ঐতিহ্য, যাকে কোনোভাবেই ক্ষুণ্ণ হতে দেয়া যাবে না। তাই ১০ টাকা মূল্যের কৃষকের অ্যাকাউন্ট যা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান এক যুগ আগে সূচনা করে গিয়েছিলেন, কৃষকের স্বার্থে তার অনুশীলন যেন অনুসরণ করা হয় সেদিকে ব্যাংক ব্যবস্থাপনাকে নজর দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে এবং কৃষি খাত খাদ্যনিরাপত্তায় ভূমিকা রাখবে, যা প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী অঙ্গীকার।
লেখক : অধ্যাপক, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা