এ কে এম শামসুদ্দিন
কিছু পুলিশ সদস্যের উগ্র আচরণ নিরাপত্তার বদলে মানুষকে আরও নিরাপত্তাহীন করে তোলে। মানুষের সঙ্গে মানবিক আচরণের পরিবর্তে আস্বাভাবিক আচরণ করা হচ্ছে। তবে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ বিষয়টি নিয়ে সতর্ক আছেন।
৩ জানুয়ারি পুলিশ সপ্তাহ ২০২৩ উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশ সদস্যদের প্রতি বেশ কিছু মূল্যবান ও উপদেশমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে একটি দক্ষ এবং বিশ্বমানের “স্মার্ট পুলিশ” গড়ে তোলা।’ তিনি তাঁর বক্তব্যে পুলিশ সম্পর্কে জনগণের ‘ভীতি’ দূর করে ভালো কাজ চালিয়ে যেতে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি পুলিশের প্রতি ‘জনগণের আস্থা’ অটুট রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করতেও বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী এরপর যে মূল্যবান কথাটি বলেছেন তা হলো, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিকল্পনা অনুযায়ী পুলিশ হবে “জনগণের পুলিশ, শোষকের পুলিশ” নয়।’ পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যের প্রতিটি কথাই দেশের বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী পুলিশের নানাবিধ কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে যথার্থই বলেছেন। পুলিশ সম্পর্কে জনগণ ভীত থাকবে কেন? আস্থার ঘাটতিই-বা থাকবে কিসের জন্য? পুলিশকে হতে হবে জনগণের বন্ধু, আস্থার স্থল। বিপদে-আপদে পুলিশই সবার আগে জনগণের পাশে এসে দাঁড়াবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী তাহলে পুলিশ সদস্যদের প্রতি এসব কথা বললেন কেন?
কোনো কোনো পুলিশ সদস্যের আচরণে জনগণ যদি ভীত না-ই হতো, কোনো কোনো কর্মকাণ্ডে পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থার ঘাটতি যদি না থাকত, তাহলে প্রধানমন্ত্রী এ কথাগুলো বলতেন না। পুলিশকে ‘শোষকের পুলিশ’ না হয়ে জনগণের পুলিশ হওয়ার কথাও উল্লেখ করতেন না।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হলো প্রশাসন। আর প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসংগঠন হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলতে প্রধানত পুলিশ সার্ভিসকেই বোঝানো হয়। পুলিশের ওপর জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও স্বাভাবিক জীবনযাপন অনেকটাই নির্ভরশীল। উন্নত বিশ্বে পুলিশ জনগণের সার্বক্ষণিক সেবায় নিয়োজিত থাকে। যেকোনো সমস্যায় জনগণ পুলিশের সাহায্য কামনা করে। পুলিশ সদস্যদের কাজই হলো জনগণের যেকোনো সমস্যায় সব ধরনের সহযোগিতা করা। অসহায়, বিপন্ন ও বিপদগ্রস্ত মানুষের প্রতি আন্তরিকভাবে সহযোগিতা ও মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। পাশাপাশি জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জনে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া। মোটকথা, পুলিশ সদস্যরা পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় জনগণের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার ও আইনের শাসনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনটির সদস্যরা তাঁদের ওপর অর্পিত সেই দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি সুবিচার করতে পারছেন কি? কয়েক বছর ধরে একশ্রেণির পুলিশ সদস্য পেশাগত অসদাচরণ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেই চলেছেন। কোনোভাবেই এসব অসৎপ্রবণ পুলিশ সদস্যদের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হচ্ছে না। রাজনৈতিক বিবেচনায় পুলিশে লোক নিয়োগ, বেপরোয়া ক্ষমতা প্রদান ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে গুরুতর অপরাধের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিয়ে লঘু শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া ইত্যাদির জন্য এসব সদস্যের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না।
কোনো কোনো পুলিশ সদস্যের আচরণে জনগণ যদি ভীত না-ই হতো, কোনো কোনো কর্মকাণ্ডে পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থার ঘাটতি যদি না থাকত, তাহলে প্রধানমন্ত্রী এ কথাগুলো বলতেন না। পুলিশকে ‘শোষকের পুলিশ’ না হয়ে জনগণের পুলিশ হওয়ার কথাও উল্লেখ করতেন না।
প্রায়ই দেখা যায়, কোনো ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেই বদলি, প্রত্যাহার, ক্লোজড বা সাময়িক বরখাস্তের শাস্তি দেওয়া হয়। এসব শাস্তিতে সাময়িকভাবে কাজের বিঘ্ন ঘটা ছাড়া কোনো প্রভাবই পড়ে না পুলিশ সদস্যদের মধ্যে। এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে বড় শাস্তি থেকে অভিযুক্ত সদস্য রেহাই পেয়ে যান। ফলে প্রচলিত এই শাস্তি পুলিশ সদস্যদের অপকর্ম কমাতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর যথাযথ তদন্তের খাতিরেই ওই পুলিশ সদস্যকে তাঁর কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার বা সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়ে থাকে। সাধারণ জনগণের ভেতর বদ্ধমূল ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিভাগীয় শাস্তির নামে যে শাস্তি দেওয়া হয়, আসলে তা কোনো শাস্তিই নয়। দেখা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে ফৌজদারি অপরাধের বিচারও করা হয় বিভাগীয় আইনে। সে ক্ষেত্রে পুলিশের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের তদন্ত এবং বিচারও করে পুলিশ। এ কারণে মানুষের ধারণা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধীরা লঘু শাস্তির আড়ালে পার পেয়ে যায়। অথচ অন্যান্য উন্নত দেশে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে আলাদা কমিশন করে বিচার করা হয়। আমাদের দেশেও পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে, সেই অভিযোগের তদন্ত ও শাস্তি নিশ্চিত করতে স্বাধীন কমিশন গঠন করা যেতে পারে। তাতে পুলিশের ভেতর অপরাধ অনেকাংশে কমে যাবে বলে আশা করা যায়।
উন্নত বিশ্বে সাধারণত ধরা হয়ে থাকে যে সমাজের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশের প্রচলিত আইন মেনে চলবে। বাকি ১০ ভাগ মানুষ আইনের বরখেলাপ করবে অথবা বিপথগামী হবে। পুলিশ তাদের নিয়ন্ত্রণ করবে অথবা আইনের আওতায় আনবে। অন্যভাবে বললে বলা যায়, পুলিশ এই ১০ ভাগ মানুষ থেকে সমাজের ৯০ ভাগ শান্তিকামী মানুষকে রক্ষা করবে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ৯০ ভাগ মানুষ কি আইন মেনে চলে বা চলার মতো পরিবেশ আছে? তবে এ কথা ঠিক, অল্প কিছু মানুষের নিয়মবহির্ভূত কাজের প্রভাব সমাজে অনেক বেশি পড়ে। পুলিশের কাজ মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সুতরাং কেউ যদি অন্যায়ভাবে আটক হন, তার প্রভাবও বেশি থাকে। সামান্যতম বিচ্যুতিও মানুষকে প্রভাবান্বিত করতে পারে। পুলিশকে আইনত মানুষের স্বাধীনতা খর্ব করার অধিকার দেওয়া আছে, তবে তা সম্পূর্ণ ন্যায়সংগতভাবে হতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, সব সময় ন্যায়সংগত উপায়ে পুলিশ কাজ করতে পারে কি?
সাম্প্রতিক কালে পুলিশের দু-একটি ঘটনা মানুষের ভেতর অসন্তোষের সৃষ্টি করেছে। গত ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের হীরাঝিল আবাসিক এলাকায় মনিরুল ইসলাম রবি নামে একজনের বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাঁকে না পেয়ে তাঁর ছোট ছেলে প্রীতমকে বাড়ি থেকে থানায় নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ আছে। একই ঘটনা ঘটেছে জানুয়ারির ১ তারিখে। মিরপুর ১ নম্বর গুদারাঘাটের ১২ নম্বর রোডের মো. জাকির হোসেনকে না পেয়ে তাঁর বড় ছেলে ইউসুফকে গ্রেপ্তার করেছে শাহ আলী থানা-পুলিশ। এই দুটো ঘটনা দেশের মূলধারার পত্রিকাগুলোয় বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে। মানুষের প্রশ্ন, দেশের প্রচলিত কোন আইনে আছে যে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে না পেলে তাঁর সন্তানকে গ্রেপ্তার করা যাবে? পুলিশের এমন বাড়াবাড়ি এবং অন্যায় কাজ সমাজে শুধু অসন্তোষ ছড়ায় না, মানুষের ভেতর ভীতিরও সঞ্চার করে। তাতে নিঃসন্দেহে পুলিশের ওপর মানুষের আস্থার ঘাটতি ঘটায়। অথচ প্রধানমন্ত্রী ৩ জানুয়ারি পুলিশ সপ্তাহ ২০২৩ উপলক্ষে পুলিশ সদস্যদের প্রতি আশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘মানুষের তথা জনগণের আস্থা অর্জন করা যেকোনো বাহিনীর জন্যই গুরুত্বপূর্ণ, আপনারা তা করে যাচ্ছেন। জনগণের মনে পুলিশের প্রতি যে আস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সেটা যেন অক্ষুণ্ন থাকে।’ এ দেশের প্রতিটি নাগরিকই চায়, পুলিশের কাছে প্রধানমন্ত্রী যে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন, তাঁরা যেন তা সততার সঙ্গে পালন করেন।
আগেই উল্লেখ করেছি, পুলিশের কাজ হচ্ছে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া। কিন্তু কিছু পুলিশ সদস্যের উগ্র আচরণ নিরাপত্তার বদলে মানুষকে আরও নিরাপত্তাহীন করে তোলে। মানুষের সঙ্গে মানবিক আচরণের পরিবর্তে অস্বাভাবিক আচরণ করা হচ্ছে। তবে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ বিষয়টি নিয়ে সতর্ক আছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হবে, সেটা নিয়ে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিনিয়ত কাউন্সেলিং করা হচ্ছে। প্রতিদিন দায়িত্ব বণ্টনের আগে কর্মকর্তারা পুলিশ সার্ভিসের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রেখে কাজ করার বিষয়ে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। থানা থেকে শুরু করে পুলিশ লাইনস, পুলিশ ক্যাম্প, বিভাগ—সবখানেই কাউন্সেলিং করা হয়। কাউন্সেলিংকালে পুলিশ সদস্যদের কোথাও তল্লাশি চালাতে হলে কী নিয়ম মানতে হবে, কী ধরনের আচরণ করতে হবে, তা বুঝিয়ে বলা হয়। সাধারণ মানুষকে যেন সম্মান দেওয়া হয়, তাদের প্রতি যেন ভদ্র আচরণ করা হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, শুধু কাউন্সেলিং করেই কি তাদের আচরণের পরিবর্তন আনা যাবে? পরিবর্তন আনতে হলে যথাযথ জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার ব্যবস্থা করতে হবে। কাজের সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি অন্যায় কাজের জন্য ন্যায়সংগত বিচার করতে হবে। গুরুতর অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তি দিতে হবে। এসবের পাশাপাশি পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের বিষয়টি লক্ষ রাখতে হবে। তাদের দিয়ে অন্যায় কাজ করানোর প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। তাদের চাপের মধ্যে না রেখে স্বাধীন ও ন্যায়সংগতভাবে কাজ করার সুযোগ করে দিলে বাংলাদেশের পুলিশ একদিন না একদিন বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘শাসকের পুলিশ’ না হয়ে ‘জনগণের পুলিশ’ হতে পারবে। নাগরিক হিসেবে আমাদেরও প্রত্যাশা, বাংলাদেশ পুলিশ একদিন আধুনিক প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হয়ে, প্রজ্ঞা ও মেধা খাটিয়ে সত্যিকারের ‘স্মার্ট পুলিশ’ হিসেবে গড়ে উঠুক এবং একই সঙ্গে এ দেশের প্রত্যেক মানুষের আস্থা অর্জন করুক।
লেখক: এ কে এম শামসুদ্দিন, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল