চৌগাছা প্রতিনিধি
যশোরের চৌগাছায় ছেলে ও ছেলের ছেলে (স্থানীয় ভাষায় পোতা ছেলে) কর্তৃক বাড়ি ছাড়া করা এক বৃদ্ধকে (অবসরপ্রাপ্ত সুগারমিল কর্মী) আড়াই মাস পর নিজের বাড়িতে তুলে দিয়েছেন চৌগাছার ইউএনও ইরুফা সুলতানা। বহস্পতিবার (১৭আগস্ট) দুপুর একটার দিকে উপজেলার পাতিবিলা ইউনিয়নের দেবিপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, বৃদ্ধ মতিয়ার রহমান (৭০) ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ সুগার মিলের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। চাকরি করে পাঁচ বিঘা জমি ক্রয় করেন চৌগাছা উপজেলার পাতিবিলা ইউনিয়নের চৌগাছা-কোটচাঁদপুর সড়ক লাগোয়া দেবীপুর গ্রামে। তিন মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে ছেলে শারীরিকভাবে কিছুটা দুর্বল হওয়ায় ১৯৯১ সালে নাবালক ছেলে আব্দুল হামিদের নামে দানসত্ত্ব দলিল করে দেন জমির সিংহভাগ। পরে পৈত্রিক জমিরও বেশিরভাগ ছেলের নামে লিখে দেন বৃদ্ধ। বাড়িসহ মাত্র ৫শতক জমি রাখেন নিজের নামে। বৃদ্ধের স্ত্রী মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। সম্প্রতি সেই লিখে দেয়া সেই জমি ছেলে আব্দুল হামিদের নামে নামজারিও সম্পন্ন হয়। এরইমধ্যে ছেলে আব্দুল হামিদ বাবাকে বলেন আমি শ^শুরবাড়ি এলাকায় জমি বর্গা চাষ করবো। তোমার জমি বন্ধক রেখে টাকা দাও। বৃদ্ধ বাবা মতিয়ার রহমান নিজের কয়েক বিঘা জমি বন্ধক রেখে ছেলেকে ২ লক্ষ ১০ হাজার, নিজের জমির গাছ বিক্রি এবং নিজের কাছে থাকা টাকা মিলিয়ে নগদ ৫ লাখ ১২ হাজার টাকা দেন ছেলেকে জমি চাষাবাদ করার জন্য।
এরপরই পিতার উপর নেমে আসে ছেলে আব্দুল হামিদ এবং এইচএসসি পড়–য়া পোতা ছেলে আমির হামজার অত্যাচার। বিভিন্ন সময়ে ছেলে ও নাতি ছেলের অত্যাচারে বৃদ্ধ মাঝে মাঝেই মেয়েদের বাড়িতে গিয়ে থাকেন। ছেলে আব্দুল হামিদ নিজের স্ত্রীকে নিয়ে শ^শুর বাড়ির গ্রামে চলে যান এবং সেখানে জমির চাষ করতে থাকেন। অন্যদিকে বৃদ্ধের বাড়িতে নাতি আমির হামজা এবং বৃদ্ধ থাকেন। প্রায় আড়াই মাস আগে বৃদ্ধের নাতি আমির হামজা বৃদ্ধকে মারপিট করে তার ব্যবহৃত ব্যক্তিগত একটি বাইসাইকেলও কেড়ে রেখে বৃদ্ধ মতিয়ার রহমানকে বাড়ি ছাড়া করেন। তাকে হুমকি দেয়া হয় এবার বাড়িতে আসলে মেরে ফেলা হবে। বৃদ্ধ ভয়ে আশ্রয় নেন পাশের গ্রামে মেয়ের বাড়িতে। সেখানে খাওয়া-দাওয়া করেন আর দিনের বেশিরভাগ সময় কাটান মসজিদে। বাড়িতে ফেরার জন্য বৃদ্ধ নানা জনকে ধরেন। কোন কাজ হয়না। ওয়ার্ডের মেম্বার, স্থানীয় গণ্যমান্য, ইউপি চেয়ারম্যান এমনকি থানা-পুলিশ পর্যন্ত স্মরাপন্ন হন বৃদ্ধ। তবে ছেলে-নাতি কোনমতেই সেসব বিচার-ফায়সালা মানতে রাজি হয়না।
এক পর্যায়ে বৃদ্ধ মতিয়ার রহমান চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানার কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। পরে ইউএনও উপজেলার সার্ভেয়ার এবং সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের ভূমি সহকারী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন ওই জমি পরিমাপ করে বৃদ্ধের জমি বুঝিয়ে দিতে। সেখানে সার্ভেয়ার জহির উদ্দিন ও ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তার সাথেও বৃদ্ধের নাতি আমির হামজা খারাপ ব্যবহার করেন। পরে ১৬ আগস্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বৃদ্ধের ছেলে ও নাতির কাছে নির্দেশনা পাঠান বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার মধ্যে বৃদ্ধের কাছে জমি ও বাড়ি বুঝিয়ে দিতে।
এতেও বুঝিয়ে না দিলে বৃহস্পতিবার দুপুরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা পাতিবিলা ইউপি চেয়ারম্যান আতাউর রহমান লাল, হাকিমপুর ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদুল হাসান, পাতিবিলা ইউপির মেম্বারবৃন্দ এবং ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাসহ বৃদ্ধ মতিয়ার রহমানের বাড়িতে যান। সেখানে বৃদ্ধের ছেলে আব্দুল হামিদ, পুত্রবধূ এবং নাতি আমির হামজাকে নিয়ে বসে বৃদ্ধ মতিয়ার রহমানকে তার বাড়ি বুঝিয়ে দেন। প্রথমে রাজি না হলেও ছেলে আব্দুল হামিদ এক পর্যায়ে বাবার কাছ থেকে নেয়া ৫ লাখ ১২ হাজার টাকার মধ্যে ৩লাখ টাকা দিতে সম্মত হন। পরে ইউএনও বৃদ্ধ বাবা, তার ছেলে ও পুত্রবধূ এবং নাতিকে একসাথে মিলিয়ে দেন।
বৃদ্ধ মতিয়ার রহমান বলেন, আমি এখন খুশি। ইউএনও ম্যাডাম বিষয়টি সমাধান করে দিয়েছেন।
এ বিষয়ে হাকিমপুর ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদুল হাসান বলেন, ‘অনেকদিন ধরেই তাদের পারিবারিক এই দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। কোনভাবেই বিষয়টি মিটছিলো না। অবশেষে ইউএনও ম্যাডামের হস্তক্ষেপে বিষয়টির সমাধান হলো।’
পাতিবিলা ইউপি চেয়ারম্যান আতাউর রহমান লাল, ‘বিষয়টি নিয়ে আমার ইউপি মেম্বাররা কয়েকবার বসলেও সমাধান হয়নি। অবশেষে বিষয়টির সমাধান হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা বলেন, ‘বৃদ্ধের অভিযোগের ভিত্তিতে সার্ভেয়ার ও নায়েবকে জমিটি মেপে সমাধান করে দিতে পাঠানো হয়। সেখানে তার নাতি সার্ভেয়ারের সাথেও খারাপ ব্যবহার করে। তিনি আমাকে জানান। ছেলে ও মেয়েদের মধ্যের দ্বন্দ্বে বৃদ্ধ বাবার সাথে খারাপ ব্যবহার করা শুরু করে। বিষয়টি তাদের বাড়িতে গিয়ে সমাধান করে দেয়া হয়েছে।