নিজস্ব প্রতিবেদক: ফাগুন এলেই একটি পাখি ডাকে/ থেকে থেকেই ডাকে/তাকে তোমরা কোকিল বলবে? বলো/আমি যে তার নাম রেখেছি আশা/নাম দিয়েছি ভাষা …।
এভাবেই মায়ের ভাষা পরম মমতায় ঠাঁই করে নিয়েছিল তার সন্তানের অন্তরে। জাগিয়ে তুলেছিল জাতিসত্তা বিকশিত করার আকাক্সক্ষাকে। সাহস জুগিয়েছিল ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের আকাক্সক্ষায়। সেই অধিকার আদায়ে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি দেয়া হয়েছিল পূূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী। সেদিন ডাকা হয়েছিল হরতাল। সভা-সমাবেশের সঙ্গে ছিল শোভাযাত্রা।
সেই কর্মসূচির বয়ান মেলে ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হকের স্মৃতিচারণে। কর্মসূচি শুরুর আগের ঘটনাপ্রবাহের উল্লেখ করেছেন তিনি এভাবে, রাত সাড়ে তিনটার সময় বিশ্ববিদ্যালয় জিমনেশিয়াম গ্রাউন্ডের মধ্য দিয়ে মেডিক্যাল কলেজের ভেতরে ঢুকি। তখন মেডিক্যাল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় এ দুটোর মাঝখানের সীমারেখা ছিল মধুর রেস্তরাঁর পাশে একটি ছোট্ট পাঁচিল। সে পাঁচিল টপকে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকি এবং রাতের শেষ সময়টুকু বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়ে দিই। ভোর হলো-সূর্য উঠল। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রথম যিনি বিশ্ববিদ্যালয় গেট পার হয়ে ভেতরে ঢুকলেন, তিনি হলেন মোহাম্মদ সুলতান। তাঁর সঙ্গে এস এ বারী, এ টি এবং আরো দুজন।
১৪৪ ধারা ভাঙ্গার জন্য ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজের ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করতে চিঠি লিখেছিলেন গাজীউল হক ও মোহাম্মদ সুলতান। কেমন করে অনুজরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করবে, সেই কৌশলও উল্লেখ করে দিয়েছিলেন চিঠিতে। সে প্রসঙ্গে গাজী হক লিখেছেন, ‘আমরা দুজন টুকরা কাগজ, সিগারেটের প্যাকেট ছিঁড়ে কিছু চিঠি লেখা শুরু করলাম। বিভিন্ন স্কুলে এবং কলেজে। চিঠিতে লেখা হয়েছিল ‘ছোট ভাইয়েরা, সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেছে। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তোমরা দুজন দুজন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এসো।
পূর্ব প্রস্তুতি অনুয়ায়ী সেদিন সকাল ৮টার পর থেকেই বিভিন্ন হল, স্কুল-কলেজ থেকে দুজন দুজন করে ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জমা হতে শুরু করে। সাড়ে নয়টার দিকে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বক্তব্য জানানোর জন্য কালো শেরওয়ানী এবং মাথায় জিন্নাহ ক্যাপ পরে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন শামসুল হক। ১৪৪ ধারা যে ভাঙ্গা ঠিক হবে না এটা বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি।
সেদিনের সকালের প্রস্তুতি সম্পর্কে মোহাম্মদ সুলতানের স্মৃতিচারণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার কথায় উঠে এসেছে সেদিনের আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্তের কথা। তিনি বলেছেন : ‘একুশে ফেব্রুয়ারির সকাল নয়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে জনাব শহীদুল্লাহ কায়সার এবং জনাব মোহাম্মদ তোয়াহা আসেন, এদেরকে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গতে যাচ্ছি একথা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিই। আধঘণ্টা পর তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানাবেন বলে জানান তারা। ইতিমধ্যে রাতভর বহু পোস্টার লেখা হয়। শহীদুল্লাহ কায়সার এবং তোয়াহা সাহেব ফিরে এসেছিলেন এবং তারা বললেন, কমিউনিস্ট পার্টি মনে করে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা ঠিক হবে না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যদি ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নিয়েই নেয় তাহলে যেন তা সত্যাগ্রহীর আকারে করা হয়। অর্থাৎ আমরা যে মিছিল করতে যাচ্ছি, সে মিছিল ১০ জন/ ১১জন করে এক একটি দল করে যেন একে একে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়। ১৪৪ ধারা জোর করে ভেঙ্গে সমস্ত আন্দোলনটি যাতে বিশৃঙ্খল-বিক্ষিপ্ত রূপ না নেয় তার জন্যই আমরা এ প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হয়েছিলাম। এরই মধ্যে পুলিশ বহু ট্রাক, বাস বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি জমা করে রেখেছে দেখলাম। সমগ্র এলাকাটিতে একটি যুদ্ধংদেহী পরিবেশ বিরাজ করছিল।