নিজস্ব প্রতিবেদক
যশোর সরকারি এম এম কলেজের ‘শহীদ আসাদ হল’ দখলে নিয়েছে শাহীন চাকলাদারের অনুসারীরা। রোববার দুপুর ১২ টার দিকে এমপি কাজী নাবিল আহমেদের অনুসারীদের হটিয়ে তারা দখলে নিয়েছেন। এর আগে ২০২৩ সালের ১৭ জানুয়ারি দীর্ঘ আট বছর ধরে নিয়ন্ত্রণে থাকা শাহীনের অনুসারীদের হটিয়ে হলটি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিলেন এমপি নাবিল অনুসারী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
শাহীন চাকলাদার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য। কাজী নাবিল আহমেদ যশোর-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য। এদিকে হল দখল নেওয়াকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। দুপুরের পর থেকে ক্যাম্পাসে দুটিই পক্ষ বহিরাগত ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মহড়া দিতেও দেখা গেছে। যদিও হলটি দখলে নেওয়ার সময়ে কলেজ সরকারি ছুটিতে রয়েছে।
ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জানিয়েছে, সদ্য শেষ হওয়া সদর উপজেলা নির্বাচনে শাহীনের প্রার্থী বিজয়ী হওয়াতে শহরে তার আধিপত্যে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে নাবিলের প্রার্থী পরাজিত হওয়াতে তার অনুসারীরা কিছুটা নড়বড়ে। এই সুযোগে শাহীনের অনুসারীরা হলটি দখলে নিয়েছে।
আসাদ হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ১৭ জানুয়ারি থেকে সরকারি এম এম কলেজের তিনতলা বিশিষ্ট শহীদ আসাদ হলটি শাহীন চাকলাদারের অনুসারী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হটিয়ে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ নেন স্থানীয় সংসদ কাজী নাবিল আহমেদ। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দিয়ে হলটি দখলে রেখে কলকাঠি নাড়তেন নাবিলের অনুসারী পৌরসভার ৪ নাম্বার ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও যুবলীগনেতা শেখ জাহিদ হোসেন মিলন।
সর্বশেষ রোববার দুপুর ১২ টার দিকে শাহীন চাকলাদারের অনুসারী জেলা আওয়ামী লীগের উপ দপ্তর সম্পাদক ওহিদুল ইসলাম তরফদার, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সালাউদ্দিন কবির পিয়াসসহ ছাত্রলীগের প্রায় ৩০ থেকে ৪০ জন নেতাকর্মী যেয়ে হলে উপস্থিত হন। এসময় হলটি দায়িত্বরত এক শিক্ষকও উপস্থিত ছিলেন। ওই সময়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হলে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের দ্রুত জিনিসপত্র নিয়ে নেমে যাওয়ার নির্দেশনা দেন। এর পর দুপুরে আসাদ হলে অবস্থানরত এমএম কলেজে নাবিল অনুসারী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হল ত্যাগে বাধ্য হয়।
কাজী নাবিল অনুসারীদের পক্ষে আসাদ হল নিয়ন্ত্রণ করতেন কলেজের ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগনেতা এনামুল হোসেন ইমন। তিনি বলেন, ‘জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির নেতৃত্বে একদল অছাত্র বহিরাগতরা আসাদ হলে আসে। তারা এসে বিভিন্ন কক্ষের তালা ভাঙ্গে। হলে এসে তারা উপস্থিত ছাত্রদের বলেন এই হল এখন থেকে শাহীন ভাইয়ের ছেলেরা নিয়ন্ত্রণ করবে। তোরা যারা আছিস সবাই চলে যা। আধা ঘণ্টা সময় দিলাম, যার যা জিনিস আছে সব গুছিয়ে হল ত্যাগ কর। তিনি বলেন, উপজেলা নির্বাচনে শাহীনের চাচাতো ভাই ফন্টু চাকলাদার বিজয়ী হয়েছেন। তার পরে তাদের অনুসারীরা বিভিন্ন মাধ্যমে হুমকি দিচ্ছিলো হল নিয়ন্ত্রণে নিবে। তিনি অভিযোগ করেন, ‘ঈদের ছুটিতে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী গ্রামে। চতুর্থ বর্ষে যাদের পরীক্ষা ছিলো তারা এসেছিলো। হল দখল শব্দটা আসাটাই দুঃখজনক। তারাও রাজনীতি করে, আমরাও রাজনীতি করি। অছাত্র বহিরাগত স্থানীয়দের নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি করার কোন দরকার ছিলো না। বহিরাগতরা হলে বা ক্যাম্পাসে এসে কেউ যদি ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি বিরুপ করে তাহলে আমরা তাদের ছেড়ে দিবো না।’
এদিন দুপুরে হলে যেয়ে দেখা যায়, কয়েকজন শিক্ষার্থী তাদের মালামাল নিয়ে ভ্যানে চলে যাচ্ছে। নাম না প্রকাশে এক চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী বলেন, ‘ছাত্রলীগের সভাপতি নির্দেশ দিয়েছে হল ছেড়ে দিতে। তাই চলে যাচ্ছি।’ এই বিষয়ে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সালাউদ্দিন কবির পিয়াসের মুঠোফোনে কয়েক দফা ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। জেলা আওয়ামী লীগের উপ দপ্তর সম্পাদক ওহিদুল ইসলাম তরফদার বলেন, ‘আসাদ হলে যারা বর্তমানে থাকে তারা বেশির ভাগ অছাত্র। তাদের জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীরা থাকতে পারে না। ২০ জন শিক্ষার্থীও থাকে না। তাই আমরা চেয়েছি ছাত্রদের জায়গা ছাত্ররাই নিয়ন্ত্রণ করবে। শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ মালামাল নিয়ে নেমে গেছে। কারও সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হয়নি। এমনকি জোর করে নামিয়েও দেওয়া হয়নি।’ সরকারি মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ের (এম এম কলেজ) ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. আবু বক্কর সিদ্দিকী বলেন, বিষয়টি জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখছি। হল দখল নিয়ে কেউ বিশৃঙ্খলা করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এই বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার বলেন, ‘কে কারা হল দখল করেছে জানা নেই। আমাদের কোন কর্মী বা নেতা কাউকে মিছিল-মিটিং ও সমাবেশে যোগ দিতে বাধ্য করে না। দলের প্রতি ভালোবাসাতে তারা কর্মসূচিতে আসে। এখানে কোন প্রভাব আধিপত্যের কোন বিষয় না।’ আর নাবিলের মুঠোফোনে কয়েক দফা যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
দুই পক্ষই মরিয়া :
সরকারি এম এম কলেজের আসাদ হলে ১২০ জনের সিট থাকলেও জেলা ছাত্রলীগের দু’পক্ষের নৈরাজ্য, সন্ত্রাসী কর্মকা-, হানাহানিতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কেউ থাকে না। এমনকি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হলে মাদক সেবনের অভিযোগও রয়েছে। ফলে ১২০ আসনের বিপরীতে জায়গায় বর্তমানে হলে বসবাস করেন ২৫ থেকে ৩০ জন। তার মধ্যে বেশির ভাগ অছাত্র, বহিরাগত। তারা সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সূত্র মতে, জেলা আওয়ামী লীগ দুটি গ্রুপে বিভক্ত। একটি পক্ষের নেতৃত্ব দেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার। অন্যটি স্থানীয় এমপি কাজী নাবিল আহমেদ। জেলার রাজনীতির গ্রুপিংয়ের মতো ক্যাম্পাসেও এই দুই শীর্ষ নেতার অনুসারীদের রাজনীতি বলয় রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে হল দখল, নেতাকর্মীদের ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খলার কারণে সম্প্রতি কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে।