হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, ‘মধ্যবিত্ত হয়ে জন্মানোর চেয়ে ফকির হয়ে জন্মানো ভালো। ফকিরদের অভিনয় করতে হয় না। কিন্তু মধ্যবিত্তদের প্রতিনিয়ত সুখী থাকার অভিনয় করতে হয়।’ মধ্যবিত্তের আবার সংজ্ঞা কী? মধ্যবিত্তের সংজ্ঞা অনেকটা রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের মতো। তিনি বলেছিলেন, ‘যে গল্প শেষ হইয়াও হয় না শেষ, তাহাই ছোটগল্প।’ তেমনি মধ্যবিত্তের সব ইচ্ছা-আহ্লাদ পূরণ হয়েও ফুরায় না। এটা কিনলে ওটা হয় না। কিছু পেলো তো কিছু ছাড় দিলো। সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে মধ্যবিত্তের সংসারে কাউকে না কাউকে অনেকটা ছাড় দিতে হয়। মধ্যবিত্ত জীবন আসলে অনেকটা ‘শাখের করাত’। দুদিকেই কাটে। সবকিছু রক্ষা করে বা নিয়ম মেনে চলার একমাত্র দায়িত্ব শুধু এই মধ্যবিত্তদের। সামাজিক প্রতিবন্ধকতাগুলো হাসিমুখে মেনে নেয়াটাই হয়তো মধ্যবিত্ত জীবন।
‘মধ্যবিত্ত’ নামে একটি শব্দ আছে। না ওপরে। আবার নিচেও না। মাঝামাঝি এদের অবস্থান। এ জন্য নামটি ‘মধ্যবিত্ত’। এই মধ্যবিত্তেরও আবার একটি ভাগ আছে। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত। দুই ভাই অথবা দুই বোন, অথবা এক ভাই, এক বোন। একজন মধ্যবিত্ত। অন্যজন নিম্নমধ্যবিত্ত। দুই স্তরের মানুষই বড় অসহায়। তারা মুখ ফুটে পারে না কিছু বলতে। চরম দুর্দিনেও তারা মুখ খুলতে নারাজ। বলতে নারাজ—আমি বা আমরা ভালো নেই। নিদারুণ কষ্টে আছি। বরং নিজেকে, নিজেদের লুকিয়ে রাখার প্রবণতাটাই বেশি। পাছে কেউ জেনে যায়—কী লজ্জার হবে সেটা!
তেল, চিনি, ডালসহ নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিসিবির লাইনে মানুষের লাইনও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে বিকেল গড়িয়ে গেলেও অনেককে ফিরে আসতে হচ্ছে খালি হাতে। ‘ভালো’ পোশাকের মধ্যবিত্তরাও গরিবদের সেই লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। কেউ কেউ তার মুখখানা ঢেকে রাখছেন। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, টিসিবির একটা ট্রাকের পেছন পেছন দৌড়াচ্ছেন একদল মানুষ। শারীরিক ও মানসিকভাবে কুণ্ঠিত কয়েকজন (ভালো পোশাক পরিহিত) সেই দৌড়ে অবধারিতভাবে পিছিয়ে পড়ছেন। আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, এক নারী একটা পণ্যশূন্য টিসিবির ট্রাকের পেছনে ঝুলে পড়ে মিনতি জানাচ্ছেন চাল, তেল কিংবা অন্য কোনো খাদ্যপণ্যের জন্য।
অন্য একদিন। টিসিবির ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের দীর্ঘ লাইন দাঁড়িয়ে আছে। একজন বয়স্ক মানুষকে দেখলাম অসহায় চোখে মানুষের দীর্ঘ লাইনের দিকে তাকিয়ে আছেন। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম—কী দেখছেন?
একটু যেন লজ্জা পেলেন আমার কথা শুনে। তবে পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা আমি যদি লাইনে দাঁড়াই ওরা কি আমাকে সহায়তা দেবে?’ লোকটির পরনে ভদ্র পোশাক। আমার কৌতূহল বেড়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, আপনারও সহায়তা প্রয়োজন? দেখে তো মনে হচ্ছে না।
চোখে-মুখে সীমাহীন অসহায়ত্ব প্রকাশ করে তিনি বললেন, ‘আমার এই লেবাসটা অনেক যন্ত্রণার হয়ে উঠেছে। কাউকে বিশ্বাস করাতে পারছি না আমি, আমার পরিবার দারুণ আর্থিক কষ্টে আছি। লেবাস বদলে যে পথে নামব, তা-ও তো সম্ভব না! কেউ কেউ হাত খুলে সাহায্য দিচ্ছেন। নিম্ন আয়ের মানুষ কোনো সংকোচ ছাড়াই সেই সাহায্য নিচ্ছে। কিন্তু আমাদের মতো নিম্নমধ্যবিত্ত, এমনকি মধ্যবিত্ত স্তরের মানুষেরা পড়েছি চরম বিপাকে। না পারছি হাত পাততে, না পারছি কাউকে কিছু বোঝাতে।’
পঞ্চাশের দশকে মুক্তি পাওয়া ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা ‘নাগরিক’। এই সিনেমায় তিনি স্বাধীনতা-উত্তর শহর কলকাতার সমাজে ভাঙনের চিত্র তুলে এনেছেন শিল্পীর সংবেদনশীল মন দিয়ে। ভাঙনের কেন্দ্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণি—লেখাপড়া জানা মধ্যশ্রেণির প্রতিনিধি পরিবারটি। পরিবারের প্রধান চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে নিয়ে তার ছোট্ট সংসার। অসুখের খরচ মেটাতে গিয়ে নিজের বাড়ি বিক্রি করে দিতে হয়েছে তাকে। পেনশনের আয়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে উঠে আসতে হয়েছে কলকাতার সস্তা ভাড়ার ঘিঞ্জি একটা পাড়ায়, ছোট পুরোনো একটা বাড়িতে। পরিবারের কন্যাটির ‘বয়স’ হয়ে গেলেও বিয়ে হয়নি। বয়সের কারণে পাত্রপক্ষ তাকে পছন্দ করে না।
ছেলেটি লেখাপড়া শেষ করে চাকরিপ্রত্যাশী। ইন্টারভিউ দিয়ে এসে ভীষণ আশাবাদী, এক মাসের মধ্যেই চাকরিটা হয়ে যাবে, ভাগ্য বদলে যাবে। ছেলেটা স্বপ্ন দেখে। পুরোনো ঘরের দেয়ালে টাঙানো একটা পুরোনো ক্যালেন্ডার। একটা মাঠ পেরিয়ে একটা লাল টালির বাড়ির ছবি। ছেলেটা স্বপ্ন দেখে, চাকরি হলে তার প্রেমিকাকে বিয়ে করবে এবং এ রকম একটা বাড়িতে সবাই মিলে সুখে-শান্তিতে বাস করবে। দেখতে দেখতে এক মাস পেরিয়ে যায়। হয়ে যাওয়া চাকরিটা তার হয় না। জীবন থেকে অনেকগুলো ‘এক মাস’ হারিয়ে গেলেও চাকরি আর হয় না।
ঋত্বিক একই সঙ্গে পাঁড় বাস্তববাদী ও আশাবাদী শিল্পী। তাই তিনি দূর ভবিষ্যতে কোনো একদিন সবকিছু পাল্টে যাবে—এমন আশা করেন। কিন্তু বর্তমানের নিরেট বাস্তবতার প্রতিই তার মনোযোগ। ফলে ভাঙনের কালে একটা মধ্যবিত্ত পরিবার কীভাবে ফুটপাতে সবহারাদের কাতারে নেমে যায়, সেই চিত্রই তুলে ধরেন।
আবার কি ক্ষুধার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে? প্রশ্নটি এখন অনেকের ভেতরে নীরবে তোলপাড় করছে। অনেক জায়গায় খবর পাওয়া যাচ্ছে, কেউ কেউ পুরো দিন না হলেও একবেলা অভুক্ত আছেন। সেসবের সরকারি-বেসরকারি সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। খাদ্যসংকটের এই ছবি আপাতদৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। এত উন্নয়নের ঝিলিক চারিদিক, তবুও কেন ক্ষুধা? এর উত্তর অনুসন্ধানসাপেক্ষ, কিন্তু অতীত সাক্ষ্য দেয় যে, শস্যের ফলন যথেষ্ট হলেও, মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অভাবে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। আশি বছর আগে ভয়ানক মন্বন্তর শস্যের অভাবে হয়নি, হয়েছিল চালের দাম মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার জন্য।
কোনো আশঙ্কাই তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। অতিমারিতে কর্মহীনতা বেড়েছে। বেকারত্বের সুযোগে মজুরি কমেছে বহু ধরনের কাজে। তার ওপর দ্রুত বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। বিশেষত জ্বালানি, ভোজ্য তেল ও ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি মানুষের বিপন্নতা বাড়িয়েছে। দারিদ্র্য যে অত্যাবশ্যক পণ্যগুলোতেও ব্যয় কমাচ্ছে, তার ইঙ্গিত অতিমারির আগেই মিলেছিল। এখন খাবার কিনতেও টাকায় টান পড়ছে। একই সঙ্গে, জনকল্যাণমুখী প্রকল্পগুলো নিয়ে রাজনীতির বাগাড়ম্বর বাড়ছে, অথচ সেগুলো মূল্যায়নের উদ্যোগ কমছে। আত্মহত্যা প্রবণতা বেড়েই চলছে।
ক্ষুধার অন্ধকার, বাজারের বিবিধ অন্যায্যতা ও প্রশাসনিক নীতির ব্যর্থতা নিয়ে অনুসন্ধানের অনুরোধ করলেও সরকার ক্ষুব্ধ হয়। আশি বছর আগে ব্রিটিশ সরকার মন্বন্তর গোপন করতে সংবাদমাধ্যমে ‘দুর্ভিক্ষ’ কথাটির উল্লেখ নিষিদ্ধ করেছিল। আজও অনাহার, অর্ধাহার, অপুষ্টি, খাদ্য মূল্যবৃদ্ধির উল্লেখ অসহনীয় স্পর্ধা বলে দেখা হয়। কঠোর বাস্তবকে মুখের কথায় বাতিল করতে বড় কিংবা মাঝারি নেতাদের জুড়ি নেই। তাদের দেয়া পরিসংখ্যানে মধ্যবিত্তের পেট ভরে না।
মধ্যবিত্তের কষ্ট নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একজন লিখেছেন, ‘নীরবে ভিজে যায় চোখের পাতা। কষ্টের আঘাতে বেড়ে যায় বুকের ব্যথা, জানি না এভাবে কাটাতে হবে কত দিন? আমার এই জীবনে কি আসবে না সুখের দিন?’ সুখ তো পরের কথা। এখন প্রয়োজন বেঁচে থাকার সংগ্রামে পারস্পরিক সহযোগিতা। সেখানে ‘মধ্যবিত্তরা’ সমাজের একটি অংশ।
সমাজে পরিবর্তন হচ্ছে ঘূর্ণায়মান একটি বিষয়। শুধুই ঘুরছে তো ঘুরছে। চারিদিকে পরিবর্তন হচ্ছে। নতুন নতুন পরিবর্তন। এত সব পরিবর্তনেও ‘গনি মিয়া’ বাস করে। বলা যায়, একটি বই, মলাট আলাদা শুধু। সবই এক, প্রেক্ষাপট আলাদা। প্রশ্ন হচ্ছে, সমাজ পরিবর্তনের মাপকাঠি কে ঠিক করবে? রাষ্ট্রের বিত্ত-বৈভবে যদি বিরাট বৈষম্য সৃষ্টি হয়, তার মধ্যে পরিবর্তন ঘটে, তাহলে সমাজের মধ্যে যে ভারসাম্য, তা হারিয়ে যায়। কিন্তু সময় ও বাস্তবতা পাল্টালেও সেই স্যাটোয়ার ‘গনি মিয়া’ একই চরিত্রে মূর্তমান।
লেখক: প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন
