প্রধান শিক্ষককে হত্যার হুমকির অডিও ভাইরাল
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক: যশোর সদরের ইছালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে হত্যার হুমকি দিয়েছেন যুবলীগ নেতা মাজহারুল ইসলাম মাজহার। তিনি যশোর সদর উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। মোবাইল ফোনে হুমকির কথোপকথনের অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। আর জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম। এ ঘটনা ভাইরাল হওয়ার পর থেকে প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম মোবাইল ফোন বন্ধ রেখে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তার পরিবার। তবে মঙ্গলবার দুপুরে যশোর পুলিশ লাইনে ডিবি কার্যালয়ে শিক্ষক রবিউল ইসলামকে ঘটনা জানার জন্য ডেকে আনা হয়।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যুবলীগ নেতা মাজহারুলকে ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করেছে বলে শহরে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে মাজহারুলকে ডিবি কার্যালয়ে আনা হয়েছে। তবে ডিবির ওসি রুপণ কুমার সরকার গ্রেফতারের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
গত ৩১ ডিসেম্বর যশোর কোতোয়ালি মডেল থানায় ভুক্তভোগী প্রধান শিক্ষকের করা জিডিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, যশোর সদর উপজেলার ইছালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়টির ম্যানেজিং কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আগের কমিটির অগোচরে যুবলীগনেতা মাজহার ও তার সহযোগীরা এডহক কমিটির সভাপতি হিসাবে মনিরুজ্জামানকে নিযুক্ত করেন। এতে ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ও অভিভাবকরা ওই কমিটির বিরুদ্ধে অনাস্থা আনাসহ একজন অভিভাবক হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন। বর্তমানে আদালতে মামলাটি চলমান রয়েছে।
গত ২৪ মার্চ দুপুর দুইটার দিকে মাজহার তার ০১৭১১৪৮৭৭১৯ নম্বর থেকে প্রধান শিক্ষককে ফোন দিয়ে কমিটি অনুমোদনের জন্য আবেদন করতে বলেন। তাকে কমিটির বিষয়ে মামলা চলমান রয়েছে জানালে গালিগালাজসহ জীবননাশের হুমকি দেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই জিডির মাধ্যমে নিরাপত্তা চেয়ে তিনি প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছিলেন। এদিকে সোমবার রাতে যুবলীগনেতা মাজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলামের মুঠোফোনে হুমকির কথোপকথনের অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। সোমবার রাত থেকেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ওই কথোপকথনের অডিও। এখন বিষয়টি টক অব দ্যা টাউন। একজন শিক্ষককে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ জীবননাশের হুমকি দেওয়ায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মাঝে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ৬ মিনিট ৮ সেকেন্ডের কথোপকথনের অডিওতে শোনা যাচ্ছে, যুবলীগনেতা মাজহারুল বারবার অকথ্য ভাষায় প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলামকে গালিগালাজ করতে। তবে প্রথমেই যুবলীগনেতা প্রধান শিক্ষককে ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করেন।
এ বিষয়ে স্কুলের সহকারী শিক্ষক কামরুজ্জামান বাচ্চু জানিয়েছেন, প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আছে। কিন্তু কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে কোন শিক্ষককে এভাবে গালিগালাজ ও হত্যার হুমকি মোটেই কাম্য নয়।
সহকারী প্রধান শিক্ষক আক্তারুজ্জামান জানিয়েছেন, যুবলীগ নেতা মাজহারুল স্কুলে এসে আমাদের সামনেই ফোন করে প্রধান শিক্ষককে শাসান। এরপর থেকে তিনি ভয়ে তটস্থ আছেন। ঠিকমত স্কুল করতে পারেছন না। আমরাও ভীতসন্ত্রস্ত। আমরা স্কুলে পাঠদান করতে আসি। আমাদের সাথে এমন আচরণ কোনভাবেই কাম্য নয়।
যশোর পুলিশের ডিবি কার্যালয়ে বসে প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম বলেন, যশোর সদর উপজেলার ইছালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়টির ম্যানেজিং কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আগের কমিটির অগোচরে যুবলীগ নেতা মাজহার ও তার সহযোগিরা এডহক কমিটির সভাপতি হিসাবে মনিরুজ্জামানকে নিযুক্ত করেন। এতে ম্যানেজিং কমিটির সদস্য এবং অভিভাবকরা ওই কমিটির বিরুদ্ধে অনাস্থা আনাসহ একজন অভিভাবক হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন। বর্তমানে মামলাটি চলমান। কিন্তু এর মধ্যে মাজাহারুল আমাকে কমিটির জন্য আবেদন করতে বলছে। মামলাটি নিষ্পত্তি হলে কমিটির আবেদন করা হবে জানায়। পরে ফোনে হুমকি-ধামকির ঘটনা ঘটে। আমি পরিবার পরিজন নিয়ে ভয়ে আছি।
তিনি আরও বলেন, অডিও ভাইরাল হওয়ার পর ডিবি পুলিশের ওসি আমাকে ফোন দিয়ে দেখা করতে বলেছেন। যে কারণে ডিবি অফিসে এসেছি। এ ঘটনায় সুষ্ঠু বিচারের জন্য শিক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
ভাইরাল হওয়া কথোপকথনের অডিওটা তার বলে নিশ্চিত করেছেন অভিযুক্ত যুবলীগ নেতা যুগ্ম মাজহারুল ইসলাম মাজহার। তবে কিছু কথা এডিট করা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, স্থানীয় সংসদ কাজী নাবিল আহমেদ এডহক কমিটির সভাপতি হিসাবে মনিরুজ্জামানকে নিযুক্ত করতে ডিও লেটার দেন। প্রধান শিক্ষকের কাছে গেলে তিনি মামলার অজুহাত দিয়ে কমিটির আবেদন করছেন না। তাই উত্তেজিত হয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষককে বেশকম কিছু কথা বলেছি। স্যারকে যা কিছু বলেছি সব রাগের মাথায় বলেছি।
এ বিষয়ে যশোর পুলিশের মুখপাত্র ডিবি পুলিশের ওসি রুপণ কুমার সরকার জানিয়েছেন, অডিওটা অনেকবার শুনেছি। খুব বাজে ল্যাঙ্গুয়েজ। শোনা যায় না। আর এ বিষয়ে মিডিয়ার সামনে বক্তব্য না দেয়ার ব্যাপারে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা রয়েছে।
ভাইরাল হওয়া অডিও ক্লিপে শোনা যায় যুবলীগ নেতা মাজাহার জেলা যুবলীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী লোক পাঠাতে চেয়েছিলেন। এ বিষয়ে মোস্তফা ফরিদ আহমেদ জানান, ভাইরাল হওয়া অডিও ক্লিপের বিষয়টি তিনি লোকমুখে শুনেছেন। তবে এই বিষয়ে তার কোন সম্পৃক্ততা নেই। একই সাথে একজন শিক্ষকের সাথে এমন আচারণের কারনে ওই যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, যথাযথ নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তুলে ধরা হলো কথোপকথন
মাজহারুল : স্যার কোথায় আছেন?
প্রধান শিক্ষক: আমি অসুস্থ বাসায় আছি।
মাজহারুল : কমিটির আবেদন করবেন না আপনি?
প্রধান শিক্ষক: এখনো তো করেনি। আমি সুস্থ হয়ে নেই। দেখি কি করা যায়।
মাজহারুল : আমার এমপি সাহেব (যশোর-৩ আসনের সংসদ কাজী নাবিল আহমেদ) আমারে পাঠিয়েছে। এখন আমি স্কুলে আপনার চেয়ারের সামনে বসে আছি। ফরিদ ভাই (সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তফা ফরিদ আহম্মেদ চৌধুরী) কালকে আপনার বাসায় লোক পাঠাতে চেয়েছিলো। কিন্তু আমি বলেছি আপনি অসুস্থ, তাই আসেনি। ফিঙ্গে লিটনের (যশোরের তালিকা ভুক্ত সন্ত্রাসী) গাঁজাখোঁর ইয়াবা খোঁর ছেলে-পেলে যেয়ে আপনার সাথে যদি খারাপ ব্যবহার করে। তা হলে পরবর্তীতে আমার ঘাড়েই আসে।
প্রধান শিক্ষক : না… খারাপ ব্যবহার করবে কেন।
মাজহারুল : আপনি আর কথা বলবেন না। আপনার কোন কথা জীবনে আর শুনবো না। আপনি কমিটির দরখাস্ত করবেন না, করবেন.. সেটা গতদিন আপনাকে জানিয়েছি। কালকে এসপির সাথে কথা হলো, হাশিমপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কমিটি আপনার আরো তিনমাস পরে মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু সেই কমিটি ইতোমধ্যে বের হয়ে গেছে। আপনি কার ক্ষমতায় এই কমিটির আবেদন করছেন না; সেটা আপনাকে বলতে হবে? আর যদি না করেন তা হলেও বলে দিতে হবে আমি এই কমিটির আবেদন করবো না। তার পরে আপনার সাথে বুঝবো পরে এই বিষয়ে।
প্রধান শিক্ষক : তুমি আমার কথা শুনবা না কেন। তোমারে ফোন দিলেই তুমি কেটে দাও শুধু। আমার ফোনটা ধরতে হবে। আর কথাটা শুনতে হবে।
মাজহারুল : আচ্ছা বলেন বলেন।
প্রধান শিক্ষক: আমি কি আবেদন করবো। যারা মামলা করেছে; তাদের সাথে তো আমার কথা বলা লাগবে না কি? মামলা তুলে দেওয়া লাগবে না?
মাজহারুল : ওরা মামলা তুলছে না কেন? (উত্তেজিত কণ্ঠে) আপনি আমারে মামলা বুঝান। আমার এই অল্প বয়সে আমি ৫টা মার্ডার মামলা খেয়েছি। আপনি আইন শেখান। ওই মামলার কাগজপত্র ৬ মাস পরে সব বাতিল হয়ে যাবে। আপনার কত বড় ক্ষমতা আপনি এমপি সাহেবের কথা শুনছেন না। সব মামলা আপনি করাচ্ছেন।
প্রধান শিক্ষক : না আমি করাতে যাবে কেন ? মামলা তুলে না নিলে কমিটির আবেদন করা যাবে না তো। তাই সবার সাথে কথা বলতে হবে। আমি বলবো, তুমি বলবা।
মাজহারুল : শুনেন স্যার আমি কারো সাথে কথা বলতে পারবো না। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কার সাথে কথা বলবেন না ; কি বলবেন আপনি জানেন। আপনার কোন মা বাপ (গণমাধ্যমে অপ্রকাশযোগ্য অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ) আছে তাদের সাথে কথা বলেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কমিটি যদি আবেদন না করেন, তা হলে আপনি যদি যশোর থাকতে পারেন। তার পরে আমি চুড়ি পরে এই যশোরে ঘুরে বেড়াবো। (গণমাধ্যমে অপ্রকাশযোগ্য অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ) হত্যার হুমকি। আমি আপনার সাথে দুই বছর ভালো ব্যবহার করেছি। তোমার কিডা ঠেকাই আমি দেখবানে। তোর এতো বড় সাহস তুই কাজী নাবিল আহমেদের ডিও লেটারে মামলা করেছিস। তোর কিডা আছে। তুই আজকের পর থেকে নীলগঞ্জে কিভাবে থাকিস দেখবানে। তোর লোকজন পুলিশ-র্যাব নিয়ে থাকিস। আমি আসছি।
প্রধান শিক্ষক: তুমি কথাবার্তা ভদ্রভাবে বলো।
মাজহারুল : আমরা যেভাবে ভদ্রতা জনগণকে দেখাই, তত ভদ্র কিন্তু আমি না।
প্রধান শিক্ষক: তুমি আমার ছাত্র ছিলে, এভাবে বলছো কেন।
মাজহারুল : অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে বলে, এই শহরে এমন কোন অফিসার নেই। আমাকে দেখে নাবিল সাহেবের প্রতিনিধি মনে করে উঠে দাঁড়িয়ে চেয়ার এগিয়ে দেয়। আর তোর কত বড় সাহস! তুই নাবিল আহমেদের ডিও লেটারের পরও এখনো কমিটি আবেদনের দরখাস্ত দিস নে। তোর যে আব্বাগুলো আসে, তাদের বলবি। মাজহারুল এই এই হুমকি দিয়েছে। তাদের আমারে কিছু করে নিতে বলিস।
প্রধান শিক্ষক: কাউকে বলা লাগবে না। আমি সুস্থ হয়ে নেই। তার পরে দেখবানে।
মাজহারুল : তা তোর সুস্থ হওয়া লাগবে না। তুই কিভাবে যশোরে থাকিস আমি দেখবানে। তুই যদি যশোরে থাকতে পারিস। আমি আর যশোরে রাজনীতি করবো না। তোর চাকুরি থাকে কিনা দেখিস। তোরে এতোদিন কিছু বলেনি। এতোদিন ভদ্রতা দেখাইছি। তুই আমার স্যার তাই। এখনো অভদ্রতার কিছু দেখিস নে তুই। (অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে) তুই জামায়াত করে এখনো এই জায়গায় আছিস তোর কপাল ভালো।
এই বলে ফোন কেটে দেন ওই যুবলীগনেতা।