নিজস্ব প্রতিবেদক: ছয় বছরের শিশু আরাবুর রহমান তাওসিন বায়না ধরেছিল বাবার সঙ্গে হোটেলে পরাটা খাবেন। ছেলের বায়না মেটাতে হাতে ধরে তাকে বাড়ির পাশেই বাজারে নিয়ে আসছিলেন বাবা হাবিবুর রহমান। হোটেলে প্রবেশের আগেই একটি দ্রুতগতির কাভার্ড ভ্যান বাবা-ছেলেকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই মারা যান। একই ঘটনায় তাদের সঙ্গে মারা গেছে আরো তিনজন।
শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টার যশোর-মণিরামপুর সড়কের বেগারীতলা এলাকায় এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন, বেগারীতলা বাজারের পাশের টুনিয়াঘরা গ্রামের হাবিবুর রহমান (৪০), তার মাদ্রাসা পড়ুয়া ছেলে আরাবুর রহমান তাওসিন (৬), একই গ্রামের সামছুর রহমান (৭০), তৌহিদুল ইসলাম (২৮) ও জয়পুর গ্রামের জিয়াউর রহমান (৩৫)।
বাড়ির সামনে স্বামী আর আদরের ছোট ছেলের এমন মৃত্যুতে মুহূর্তেই নির্বাক হয়ে যায় মা তহমিনা খাতুন। ঘটনার পর থেকে তিনি বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। কাউকে দেখলে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকছেন। কোনো কথা বলছেন না। মাঝে মাঝে সন্তানের নাম ধরে আহাজারি করছেন। স্বামী আর সন্তানহারা এই মায়ের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠে টুনিয়াঘরার আকাশ বাতাস। অনেকেই সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছে।
কান্না কণ্ঠে তহমিনা খাতুন বলেন আমার কলিজার টুকরারে এভাবে আল্লাহ নিয়ে গেলো। সন্তানের সাথে আমার স্বামীরেও। আমি কি করে সহ্য করবো আল্লাহ। আমার ঘরটা একপ্রকার ফাঁকা করে চলে গেল। আমার পাখিটা কত মা মা করে পাগল করে দেয়; আর ডাকবে না রে…. আল্লাহ।
টেলিভিশন দেখতে দেখতে সকালে ছোট ছেলে বায়না ধরেছিলো পরাটা খেয়ে মাদ্রাসায় যাবে। সেই পরাটাও খেতে পারলো না রে……। আকাশের দিকে দুই হাত তুলে আর্তনাদ করে তিনি বলতে থাকেন, কি এমন পাপ করেছিলাম আল্লাহ; যার কারণে একসঙ্গে আমার স্বামী আর ছোট ছেলেরে এভাবে কেড়ে নিতে হলো! এখন আমি কি নিয়ে বাঁচবো। আমাদের কি হবে আল্লাহ। একসঙ্গে আমাদের দুটি প্রাণ নিয়েছে যারা তাদের অবশ্যই বিচার করতে হবে সরকারকে।
পাশেই তহমিনা খাতুনের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া আরেক ছেলে তাহমিদ রহমান তাজিমকে ঘিরে জটলা। তাকে ঘিরে সান্ত্বনা দিচ্ছেন নিকট আত্মীয় ও প্রতিবেশিরা। তারা তাজিমকে
বুঝাচ্ছেন বড় হতে হবে, সংসারের হাল ধরতে হবে। কান্না করলে হবে না! তুমি শক্ত না হলে তোমার মা আরো ভেঙে পড়বে।
তাহমিদ রহমান তাজিম বলেন, প্রায় প্রতিদিনই ছোট্ট ভাই তাওসিন মাদ্রাসা যাওয়ার আগে বায়না ধরে পরাটা খাবে। পরাটা না খেতে দিলে মাদ্রাসাই যাবে না। বাবার হাত ধরে বাড়ির পাশেই বেগারিতলা বাজারের একটি হোটেলে যাচ্ছিলেন তারা। হোটেলে প্রবেশের আগেই যশোর থেকে সাতক্ষীরাগামী একটি কাভার্ড ভ্যান বাবা আর ছোট ভাইকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই মারা যায় তারা।
কান্না কণ্ঠে তাজিম বলেন, ওরে আব্বু তুমি আমাদের ছেড়ে চলে গেলে। এখন আমাদের কে দেখবে। আদরের তাওসিনও চলে গেল। আমরা যে নিঃস্ব হয়ে গেলাম।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, শুক্রবার সকাল ৭টার দিকে যশোর থেকে সাতক্ষীরাগামী একটি কাভার্ডভ্যান যশোর-মনিরামপুর সড়কের বেগারিতলা এলাকায় পৌঁছালে চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। এ সময় কাভার্ডভ্যানটি রাস্তার পাশে হোটেল, চায়ের দোকানসহ কয়েকটি দোকানে ধাক্কা দেয়।
এতে চায়ের দোকান ও হোটেলে নাস্তা করতে আসা এবং পথচারী মিলে পাঁচজন মারা যান। প্রত্যক্ষদর্শীরা আরো জানান, ড্রাইভার ঘুমে অচেতন অবস্থায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। এ সময় কাভার্ডভ্যানটি রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে ধাক্কা দেয়। দোকানগুলো ভেঙ্গে চুড়মার করে দিয়েছে ঘাতক কাভার্ড ভ্যান।
মণিরামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ মো. মনিরুজ্জামান বলেন, চারজনের মরদেহ যশোর জেনারেল হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। আর এক শিশুর মরদেহ তার স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ঘাতক ড্রাইভার ও হেলপার পলাতক রয়েছে। তাদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান চলমান আছে।