আশ্যয়হীন জনপদে চলছে মানুষের হাহাকার
খাদ্য ও খাবার পানির তীব্র সংকট
শ্যামনগর থেকে ফিরে আব্দুল ওয়াহাব মুকুল: আজ ভয়াল ২৫ মে। সর্বগ্রাসী আইলার ১৩ বছর পেরিয়ে গেলেও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকুলজুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত আইলা কবলিত হাজার হাজার পরিবার এখনও পূনর্বাসিত হয়নি।
আশ্রয়হীন জনপদে এখনও চলছে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও খাবার পানির জন্য তীব্র হাহাকার। সর্বগ্রাসী আইলা আজও উপকুলীয় অঞ্চল সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত হাজার, হাজার মানুষকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৯ সালের ২৫ মে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘুর্নিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট সর্বনাশা আইলা আঘাত হানে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকুলীয় জনপদে। মুহুর্তের মধ্যে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, আশাশুনি ও খুলনা জেলার কয়রা ও দাকোপ উপজেলার উপকুলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা লন্ডভন্ড হয়ে যায়। স্বাভাবিকের চেয়ে ১৪-১৫ ফুট উচ্চতায় সমুদ্রের পানি এসে নিমিষেই ভাসিয়ে নিয়ে যায় নারী ও শিশুসহ কয়েক হাজার মানুষ, হাজার হাজার গবাদী পশু আর ঘরবাড়ি । ক্ষণিকের মধ্যে গৃহহীন হয়ে পড়ে লাখো পরিবার। লাখ লাখ হেক্টর চিংড়ি আর ফসলের ক্ষেত তলিয়ে যায়। ধ্বংস হয়ে যায় উপকুল রক্ষা বাঁধ আর অসংখ্য ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
সর্বনাশা আইলার আঘাতে শুধু সাতক্ষীরায় নিহত হয় ৭৩ জন। আর আহত হয় দুই শতাধিক মানুষ।
আইলার পর থেকে এসব এলাকায় সুপেয় পানি সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করে, যা এখনও অনেকটা চলমান। খাবার পানির জন্য ছুটতে হচ্ছে মাইলের পর মাইল। আইলা কবলিত এ অঞ্চলের রাস্তাঘাট, উপকুলীয় বেড়িবাঁধ এখনও ঠিকমত সংস্কার হয়নি। ফলে উচ্চ বিত্ত থেকে শুরু করে নিম্মবিত্ত সবাই চালাচ্ছে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। ক্ষতিগ্রস্ত আইলা কবলিত এ বিশাল জনপদে খুবইকম সংখ্যক সাইক্লোন সেন্টার রয়েছে যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। আইলা’র ভয়াবহতায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ও পদ্মপুকুর ইউনিয়নে বসবাসরত মানুষের চোখে মুখে এখনও ভয়ংকর সেই স্মৃতি। আইলার আঘাতের পর থেকে গোটা এলাকা উদ্ভীদ শুন্য হয়ে পড়ে।
কৃষি ফসল ও চিংড়ি উৎপাদন বন্ধ থাকায় গোটা এলাকাজুড়ে তীব্র কর্মসংস্থানের সংকট দেখা দিয়েছে। কর্মহীন মানুষ অনেকেই এলাকা ছেড়ে কাজের সন্ধানে বাইরে চলে গেছে। অপরদিকে, বনদস্যুদের অত্যাচারে সুন্দরবন, কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদীর ওপর নির্ভরশীল এ এলাকার মানুষের জীবন যাপন দূর্বিসহ হয়ে পড়ে, যা এখন র্যাব ও কোস্ট গার্ডেও উপর্যুপরি অভিযানে একপ্রকার নির্মুল হয়েছে।
বিকল্প কর্মসংস্থানের কোন ব্যবস্থা না থাকায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারছেন না উপকুলীয় এ জনপদের প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। আইলার পরপরই কিছু সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কাজের বিনিময় খাদ্য প্রকল্পের কাজ হলেও এখন আর কোনো কাজ হচ্ছে না। আর এ কারণেই ক্রমে ক্রমে বাড়ছে দরিদ্র ও হত দরিদ্রের সংখ্যা।
আইলার আঘাতের পর সব সুযোগ হারিয়ে যাওয়া মানুষের জীবন ধারণের জন্য বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো তাদের উদ্যোগে মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে। লবণ পানিকে মিষ্টি পানিতে রূপান্তরিত করে খাবার উপযোগী করছে। পুকুর খনন করেছে।
এদিকে, আইলার ১৩ বছর অতিবাহিত হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপকুল রক্ষা বেড়িবাঁধগুলোর অনেক স্থানে ভয়াবহ ফাঁটল দেখা দেয়ায় এবং সংস্কার না করায় সামান্য ঝড় কিম্বা বৃষ্টিতে ঝূঁকির মধ্যে থাকতে হচ্ছে এ জনপদের কয়েক লাখ মানুষের। তাই উপকুলীয় এ জনপদের মানুষের সরকারের কাছে কর্ম সংস্থান ও খাদ্য সহায়তার আগে তাদের প্রানের দাবী টেকসই উপকুল রক্ষা বেড়ি বাধ নির্মান ও পরে বেকার জনগোষ্ঠির কর্মস্থানের ব্যবস্থা করা হোক।
এ ব্যাপারে শ্যামনগর উপজেলা ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী অফিসার জানান, আইলার পরে প্রায় ৪৮ হাজার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সহযোগিতা দেয়া হয়েছে। একই সাথে দেয়া হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত পবিার প্রতি ২০ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান। তিনি আরো জানান, সরকারী-বেসরকারী ভাবে আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে বিভিন্ন প্রশিক্ষনের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। বাঁধ সংস্কারের কাজও করা হয়েছে। তিনি আরো জানান, সুপেয় পানির সমস্যাও দ্রুত দুর হয়ে যাবে।
