কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ) প্রতিনিধি: শেষ সম্বল বলতে মাঠে আবাদি জমি ছিলো মাত্র ১৯ কাঠা। ২০২০ সালে ৩ লক্ষ ৯০ হাজার টাকায় শেষ সম্বল টুকু বিক্রি করে সুদে মহাজনের হাতে তুলে দিয়েছেন। তার পরও শোধ হয়নি সুদে নেওয়া ৫০ হাজার টাকা।
বলছিলাম ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার পুকুরিয়া গ্রামের বদ্দিনাথ শর্মার ছেলে সুজন কুমার শর্মার কথা। তিনি ২০১৮ সালে শহরের নতুন বাজারের শাজাহানের সিয়াম সমবায় সমিতি লি. এর নিকট থেকে ৫০ হাজার টাকা সুদে নেন। ওই টাকার বিনিময়ে তাকে প্রতি সপ্তাহে ৫ হাজার টাকা করে দিতে হতো। এ পর্যন্ত সুজন প্রায় সাড়ে ছয় লাখ টাকা দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও শোধ করতে পারেননি সুদে নেওয়া ৫০ হাজার টাকা। সুজনের মায়ের ব্যাংক চেকে জোর করে সুজনের স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছেন শাজাহান। সেই সাথে ফাঁকা একটি স্টাম্পেও। সুজন টেলিকম নামের একটি দোকান ছিলো। তার সেটিও হাতছাড়া হয়েছে। সব হারিয়ে তিনি এখন দিশেহারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুদে টাকা নেওয়া একাধিক ব্যক্তি জানান, আমরা বিপদে পড়ে তাদের কাছ থেকে টাকা নিই। কিন্তু একদিন টাকা দিতে দেরি হলে আমাদের সাথে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। সমবায় সমিতির বিভিন্ন নাম দিয়ে সুদে কারবারিরা খুলেছেন ডেইলি কিস্তির (প্রতিদিন আদায়) সমিতি। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে গড়ে উঠেছে এমন অসংখ্যা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি। চাকুরিজীবী, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুয়ের সরলতার সুযোগ নিয়ে এইসব সুদে মহাজনরা বিপদ মুহূর্তে চড়া সুদের টাকা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ান। সুদের টাকা নিয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার হলেও আস্তে আসেÍ এই সুদের টাকায় যেনো তাদের জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। প্রসাশনের নাকের ডগাই চলছে রমরমা এই সব সুদে ব্যবসা। এইসব সমিতির আবার নিবন্ধন নম্বরও রয়েছে। উপজেলা সমবায় অফিস এসব দেখেও না দেখাব ভাব করে থাকেন। এসব ডেইলি কিস্তি সমবায় সমিতির কাছ থেকে টাকা নিতে গেলে গ্রাহককে দিতে হয় একটি সাদা চেক, ১শ টাকার ফাঁকা স্টাম্পে স্বাক্ষর, জীবন বীমা বাবদ ১ হাজার ২শ টাকা ও এক লক্ষ টাকা নিতে গেলে ১০ হাজার টাকা সঞ্চয়।
সমিতির নামে সুদে টাকার ব্যাবসা বিষয়ে সিয়াম সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লি, এর পরিচালক শাজাহান বলেন, সুজন শর্মা আমার নিকট থেকে টাকা নিয়েছিল আবার শোধ করে দিয়েছে। তবে, সে জমি বিক্রি বা কিভাবে দেওলিয়া হয়েছে তা জানিনা। আমি তাদের স্ট্যাম্পসহ যাবতীয় ডকুমেন্ট ফেরত দিয়েছি।
অনেক ভুক্তভোগী জানান, আমাদের টাকা দিতে দেরি হলে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুনতে হয়। কোন সরকারি ছুটির দিনেও মাপ নেই তাদের টাকা দিতেই হবে। ঈদ বা পূজাতেও ছাড় নেই টাকা নেওয়া মানুষ গুলোর।
এক লক্ষ টাকা নিলে প্রতিদিন ১২’শ টাকা করে গুনতে হয়। এভাবে কোন সমিতি চার মাস আবার কোন সমিতি পাঁচ মাস পর্যন্ত টাকা নিয়ে থাকেন। আবার কেউ যদি এক লক্ষ টাকা মাসিক হিসাবে নিতে চান তাহলে তাকে প্রতিমাসে ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত আসল বাদে শুধু সুদ দিতে হয়। কালীগঞ্জ শহরের সবচেয়ে বড় সুদে মহাজন ঢাকালে পাড়ার সাজাহানের সমিতির নাম সিয়াম সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লি.। যার নিবন্ধন নং- ৪৯/ঝি তাং ০১/১২/২০১৩ কোটচাঁদপুর রোড নতুন বাজার তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই তার অফিস। প্রায়ই দেখা যায় প্রসাশনের বিভিন্ন লোকজন তার ওখানে বসে আড্ডা দিচ্ছে সেই সুযোগটিও কাজে লাগান সাজাহান। প্রয়োজন সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লি. নিবন্ধন নং-রেজিঃ ১৫/ঝি তাং- ২১/০৬/২০১২ইং নামে নতুন বাজারে মাসুদ এর আরও একটি সমিতি রয়েছে।
অপর একটি ইউনিক সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড মালিক মুসা লসকর যার রেজিঃ নং- ০৬/ঝি অফিস মধুগঞ্জ বাজার দশতলা ভবনের পূর্ব পাশে চার তলায়। এছাড়াও আশার আলো সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লি. নিবন্ধন নং-রেজিঃ-৩৭/ঝি ০৬/১০/২০২১ইং মধুগঞ্জ বাজার। সূর্যের হাসি সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লি. নিবন্ধন নং-রেজিঃ২২/ঝি তাং- ০২/০৪/২০১৩ইং কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ। চিত্রা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লি. নিবন্ধন নং-রেজিঃ ২৯/ঝি স্থাপিত ২০১৯ইং, একতা সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি লি. নিবন্ধন নং-রেজি. ৪৭/ঝি স্থাপিত ২০১৮ইং,
ফয়লা গ্রামে টগর নামের এক দোকানি উন্নয়ন মূখী নামে একটি সমবায় সমিতি নাম দিয়ে তিনি বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের মাঝে ৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার সুদে টাকা দিয়ে থাকেন। তিনি এখনও কোন নিবন্ধন করেননি কালীগঞ্জ বঙ্গমার্কেটে তার দোকান।
ফয়লা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিঃ নিবন্ধন নং- রেজিঃ৩৮/ঝি তাং- ০৭/১০/২০২১ইং। এইসব সমবায় সমিতির একটিরও কোন নিদৃষ্ট সাইন বোর্ড বিা অফিস নেই। দোকান বা বাড়িতেই তাদের কার্যক্রম করে থাকেন। এছাড়া রিমন নিবন্ধন নং-রেজিঃ ০৪/ঝি, সোনারতরী, নিবন্ধন নং-রেজিঃ ৩৩/ঝি, বিবর্তন নিবন্ধন নং-রেজিঃ ০৫/ঝি, তারা এক সময় ঋণদান কার্যক্রম করতো। প্রায় ৩/৪ বছর বাদ দিয়েছেন। এখন উৎপাদন মুখী উদ্দ্যেক্তা হিসাবে কার্যক্রম করেন। লাইফ কেয়ার নিবন্ধন নং-রেজিঃ ৪৭/ঝি সমিতি সহ অধিকাংশই ডেইলি কিস্তি (প্রতিদিন আদায়) সুদে কারবারের সাথে ছড়িত।
বন্ধন সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লি. নিবন্ধন নং-রেজিঃ ৩২/ঝি তাং ৩১/০৭/২০১৪ এর মালিক মোস্তফা জানান, আপনি সমবায় অফিসে গিয়ে খোঁজ নেন। সাংবাদিক বা প্রশাসন কিছু জানতে চাইলে আমরা তাদেরকে সমবায় অফিসে পাঠিয়ে দিই।
এই বিষয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা সমবায় অফিসার আসাদুজ্জামান জানান, আমাদের এখন সমবায় দিবস চলছে। ত্রুটি বা সমস্যা যেটাই আছে ৫ ই নভেম্বর সমবায় দিবস শেষে বসে জানাব। আমরা ইতিবাচক চিন্তা করি আপনারাও ইতিবাচক চিন্তা করেন।
জেলা সমবায় অফিসার জাফর ইকবল জানান, সমবায় সমিতি তাদের এজিএম এর সিদ্ধান্তের উপর চলবে। কিন্তু কোন ভাবেই ৩০% এর বেশি সুদ নিতে পারবেনা। যদি কোন সমিতি ৩০% এর বেশি সুদ নেই আর আমরা তার প্রমাণ পাই, তাহলে তার নিবন্ধন বাতিলসহ অইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাদিয়া জেরিন জানান, কালীগঞ্জে সমবায় সমিতি আছে সেটি আমি জানি। কিন্তু কেউ সমবায় সমিতির নামে সুদে ব্যবসা করছে কিনা সেটি আমি জানিনা। এমন কোন অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।