নিজস্ব প্রতিবেদক :
‘দাঁড়াও, পথিক বর, জন্ম যদি তব বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! /এ সমাধিস্থলে (জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি বিরাম) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত দত্তোকূলোদ্ভব শ্রী মধুসূদন/যশোরে সাগরদাঁড়ী-কপোতক্ষ তীরে জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি, রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী।’
নিজের লেখনীতে এভাবেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট বাঙালি কবি ও নাট্য্যকার তথা বাংলার নবজাগরণ সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব মহাকবি ও মধুকবি নামে খ্যাত বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের জনক মাইকেল মধুসূদন দত্ত। যাঁর ১৯৯তম জন্মদিন আজ ২৫ জানুয়ারি।
এ উপলক্ষে কবির জন্মভূমি যশোরের কেশবপুরের সাগরদাঁড়িতে সপ্তাহব্যাপী মধুমেলার আয়োজন করা হয়েছে। আজ বুধবার থেকে শুরু হওয়া এ মেলা চলবে ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত। সপ্তাহব্যাপী এই মেলার উদ্বোধন করবেন সাংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ এমপি। প্রতিদিন দুপুর থেকে রাত অবধি মধুমঞ্চে চলবে আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নাটক ও যাত্রাপালা।
এদিকে, করোনা মহামারির কারণে তিন বছর পর মধুমেলা শুরু হওয়ায় মধুপ্রেমীদের আগ্রহ তুঙ্গে। তাই মেলাকে স্বার্থক করতে আয়োজক কমিটি ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। দেশিবিদেশি পর্যটনসহ দর্শণার্থীদের আকর্ষণ করতে চলছে শেষ সময়ের প্রস্তুতি।
১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি। শীতের পরশ সাগরদাঁড়ি প্রকৃতির অঙ্গ জুড়ে। হঠাৎ ভেতর বাড়ির কোণের ঘরে উলুধ্বনি-শঙ্খধ্বনি। কাটিপাড়ার জমিদার গৌরীচরণ ঘোষের কন্যা জাহ্নবী দেবী আঁতুর ঘরে পুত্র সন্তান প্রসব করেছেন। এরমধ্যে কোলকাতার খিদিরপুর থেকে কর্তাবাবু রাজনারায়ণ দত্ত ফিরলেন। পুত্র ভূমিষ্ঠ হওয়ার সংবাদ শুনে আত্মহারা হয়ে গেলেন। পুত্রের জন্য সোনার চেন-বোতাম, পোশাক-আশাক, খেলনাগাড়ি, জুড়ি-টুড়ি বজরা বোঝাই করে আনলেন। দত্তবাবু পুত্র সন্তান লাভ করায় প্রজাদের ওপর রাজস্ব হ্রাস করলেন খুশি হয়ে। বাড়িতে পুত্রের মঙ্গল কামনায় বেশ ক’দিন চললো ভোজ উৎসব। খুশি জোয়ার বয়ে চললো সাগরদাঁড়ির আকাশে-বাতাসে। বেশ কয়েকদিন কাটলো আনন্দ উৎসবে। ঢাক ঢোল পিটিয়ে ঘটা করে ভেবে-চিন্তে নাম দিলেন মধু। শ্রী মধুসূদন দত্ত।
শিশুকালে মধুর হাতে খড়ি হয়েছিল তাঁদের বাড়ির চন্ডীম-পে। এরপর তিনি তাঁর গ্রামের নিকটবর্তী শেখপুরা গ্রামের এক মৌলভী শিক্ষকের নিকট ফরাসি শিখতে যেতেন। চন্ডীম-পে শিক্ষা ও মৌলভী শিক্ষকের শিক্ষায় তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি রচিত হয়েছিল। ১৮৭৩ সালে মধু হিন্দু কলেজে ভর্তি হন এবং ১৮৪১ সাল পর্যন্ত সেখানে ইংরেজি ও ফরাসি অধ্যয়ন করেন। এই সময় খিদিপুরে তাঁদের নিজের বাড়িতেই তিনি বসবাস করতেন।
১৮৪৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কবি মধুসূদন খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত হন এবং পাশ্চাত্য সাহিত্যের দুর্নিবার আকর্ষণবশত ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। এ সময় তিনি হিন্দু কলেজ পরিত্যাগ করে শিবপুরস্থ বিশপস্ কলেজে ভর্তি হন এবং চার বৎসর সেখানে অধ্যায়ন করেন। এখানে অধ্যয়নকালে তিনি গ্রিক, ল্যাটিন, ফরাসি, হিব্রু প্রভৃতি ভাষা আয়ত্ব করেন।
মাইকেল মাদ্রাজ থেকে কোলকাতায় ফিরে এসে কবি দেখলেন, তাঁর পিতা-মাতা ইতঃপূর্বেই ইহজগৎ ত্যাগ করেছেন এবং তাঁদের অনেক সম্পত্তি অন্যরা দখল করে নিয়েছে। অগত্যা মধুকবি পুলিশ আদালতে সামান্য কেরানির চাকরি গ্রহণ করেন।
জীবনের দ্বিতীয় পর্বে মধুসূদন আকৃষ্ট হন নিজের মাতৃভাষার প্রতি। এই সময়েই তিনি বাংলায় নাটক, প্রহসন ও কাব্য রচনা করতে শুরু করেন। মাইকেল মধুসূদন বাংলা ভাষায় সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি অমিত্রাক্ষর ছন্দে রামায়ণের উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত মেঘনাদ বধ কাব্য নামক মহাকাব্য। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে ফ্রান্সের ভার্সাই নগরে বসে মহাকবি লিখেন তার ‘কপোতাক্ষ নদ’ এবং ‘বঙ্গভাষা’র মতো বিখ্যাত কবিতা।
বাবা রাজনারায়ণ দত্তের বিশাল জমিদারি থেকে কবি বঞ্চিত হয়ে এক পর্যায়ে কপর্দকহীনভাবে কলকাতায় ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন মৃত্যুবরণ করেন।