আব্দুল্লাহ আল ফুয়াদ, কেশবপুর: সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে ফাঁকা মাঠের ভিতর যশোরের কেশবপুর উপজেলার মাইকেল রোড দিয়ে চলাচল করার সময় চৌরাস্তা মোড়ে আসতেই অন্ধকারে গা ঝিমঝিম করত। একই অবস্থা ছিল সোনাতোলা নামক মাঠের ভিতর। এখানে আরও ছিল চোর-ডাকাতের ভয়। এমন অনেক রাস্তাঘাট ও জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে ধাপে ধাপে স্ট্রিট লাইট স্থাপনের মাধ্যমে আলোর ব্যবস্থা করে অন্ধকার ও সন্ত্রাসীদের ভয়কে জয় করার সাহস যুগিয়েছিল গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিখা) এবং গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচি। মানুষের নির্বিঘ্ন চলাচল নিশ্চিত করেছিলো এ প্রকল্প। কিন্তু সেই আলো নিভে গেছে। দেখভালের অভাবে নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার সোলার স্ট্রিট লাইটগুলো।
স্থানীয়রা জানান, সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই সয়ংক্রিয়ভাবে জ্বলে উঠত লাইটগুলো। আবার ভোরে সূর্যের আলোতে নিভে যেত। এ যেন শেখ হাসিনা সরকারের ‘গ্রাম হবে শহর’ স্লোগানের বাস্তব চিত্র।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের আওতাধীন ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছর থেকে শুরু হওয়া এই ধারাবাহিক প্রকল্প হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে কাবিখার ১ কোটি ১৮ লাখ ৭৯ হাজার ৫৬০ টাকা খরচে ১৪৯টি স্ট্রিট লাইট স্থাপন করা হয়। এই অর্থ বছরে টিআর এর ৮ লাখ ৪৮ হাজার ৫৪০ টাকা খরচে ১১ টি সোলার স্ট্রিট লাইট স্থাপন করা হয়। যেখানে প্রতিটা লাইটে গড়ে খরচ হয় ৭৯ হাজার ৫৫০ টাকা ৬২ পয়সা। ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে কাবিখার ১ কোটি ৫৪ লাখ ২৮ হাজার টাকা খরচে ২০০ টি এবং টিআর এর ১ কোটি ৪৩ লাখ ৪৮ হাজার ৪০ টাকা খরচে ১৮৬ টি সোলার স্ট্রিট লাইট স্থাপন করা হয়। এ অর্থ বছরে সর্ব উচ্চ সংখ্যক লাইট বসানো হয়। যার গড়ে প্রতিটা লাইটে খরচ হয় ৭৭ হাজার ১৪০ টাকা। সর্বশেষ ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে কাবিখার ১ কোটি ৩৩ লাখ ৪৫ হাজার ২২০ টাকা খরচে ১৭৩ টি এবং টিআর এর ১ কোটি ৩১ লাখ ৯০ হাজার ৯৪০ টাকা খরচে ১৭১ টি সোলার স্ট্রিট লাইট স্থাপন করে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয়। যেখানে গড়ে প্রতিটা লাইটে খরচ দেখানো হয় ৭৭ হাজার ১৪০ টাকা। কেশবপুর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ৩ অর্থ বছরে ৬ কোটি ৯০ লাখ ৪০ হাজার ৩০০ টাকা খরচে মোট ৮৯০টি সোলার স্ট্রিট লাইট বসানো হয়।
অনেকগুলো ছায়াযুক্ত স্থানে লাইট স্থাপনে চার্জ উঠছে না। পরবর্তীতে বরাদ্দ না আসায় আমাদের কিছু করার নেই। আমরাও চিন্তিত। – শুভাগত বিশ্বাস, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, কেশবপুর
সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার মজিদপুর এতিমখানা সামনে মেইন রোডের পাশে ১টি লাইট বসানো হয়েছিলো সেটি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। ইউনিয়ন পরিষদের মাঠে ২টি লাইটের মধ্যে ১টি নষ্ট। আবু চেয়ারম্যানের কবরের সামনে রাস্তার পাশে ১টি ও বাগদাহ মহিউস সুন্নাহ হাফিজিয়া মাদ্রাসার সামনে ১টি লাইটের ব্যাটারি, সোলার প্যানেল চুরি হয়ে গেছে। দেউলি বাজারের ২টি লাইটের মধ্যে ১টি নষ্ট, প্রতাবপুর বাজারের ৪টি মধ্যে ১টি নষ্ট, হাসানপুর বাজারের পুরাতন কৃষি ব্যাংকের সামনে ১টি নষ্ট। সুফলাকাটি ইউনিয়নের ফেসবুক মোড়ে ৩টি নষ্ট। সাগরদাঁড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সামনে ১টি নষ্ট। সাগরদাঁড়ী কপোতাক্ষ নদীর দুই পাড়ে ৬টি নষ্ট। ত্রিমোহনি-বাঁশবাড়িয়া সোনাতোলা মাঠে ৫টি, জিয়েলতলা বাজারের ২টিই নষ্ট ছিলো পরে বাজার কমিটি থেকে মেরামত করেছে, ঝিকরা গনির মোড়ে ১টি নষ্ট।
স্থানীয়রা জানান, বর্তমানে অধিকাংশ সোলার স্ট্রিট লাইটগুলো নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। রক্ষণাবেক্ষণ বা পরবর্তীতে মেরামতের জন্য কোনো ফান্ড না থাকার কারণে অনেকের নজরে আসছে না বিষয়টি। যে কারণে জনদুর্ভোগ ফিরে এসেছে। এক সময় অন্ধকার দূর করতে আলোকিত উপজেলা গড়তে এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এখন যেন আবার গোটা উপজেলা ব্যাপি আলোর পরে অন্ধকার নেমে এসেছে।
স্থানীয়রা আরও জানান, দেখভালের অভাবে চোরেরা ব্যাটারি, সোলার প্যানেল চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এক্সপার্ট গ্রুপের ফাউন্ডার এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর এনএইচ রিমন জানান, আমরা ইতিমধ্যে ৩ বছর মেয়াদ শেষ হওয়া লাইটগুলো আবেদনের মাধ্যমে পিআইও অফিসকে জানিয়ে দিয়েছি। যেগুলোর মেয়াদ আছে অফিস সেগুলো মেরামতের জন্য বললে আমরা মেরামত করে দিবো।
কেশবপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) শুভাগত বিশ্বাস বলেন, লাইটগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সোলার প্যানেলের উপরে ময়লা পড়ার কারণে। অনেক সময় ছায়াযুক্ত স্থানে লাইট বসানোর কারণে ব্যাটারিতে চার্জ উঠছে না। প্রকল্পটি দ্রুত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হয়েছিলো যার কারণে চেয়ারম্যান, মেম্বররা যে যে স্থানের লিস্ট পাঠিয়েছিলো সেখানে সেখানে বসানো হয়েছে। ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে লাইট বসানোর সুযোগ হয়নি। পরবর্তীতে স্ট্রিট সোলার লাইটের জন্য কোনো বরাদ্দ আসেনি। যে কারণে আমাদের কিছু করার নেই। তবে বিষয়টি নিয়ে আমরাও চিন্তিত। দেখা যাক উপর মহল থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কি না।
এদিকে সরকারের কোটি কোটি টাকা এভাবে নষ্ট হওয়ায় সাধারণ নাগরিক মহলে দেখা দিয়েছে নানা ক্ষোভ। তারা সরকারি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন: কাতারকে হারিয়ে বিশ্বকাপের ইতিহাস পাল্টে দিলো ইকুয়েডর